বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর শুধু নাম নয়, পরিবর্তন এসেছে বাহিনীটির পোশাকেও। চব্বিশের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর এবার পরিবর্তন এসেছে পুলিশের পোশাক এবং মনোগ্রামে। তবে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার যেন শেষ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন পোশাক পরিধান করলেও পুলিশের আচরণে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি। পুলিশের নতুন পোশাক দিয়ে কার স্বার্থ হাসিল হয়েছে এমন প্রশ্নও ছুড়েছেন অনেকে। তবে বিজিবির নাম কিংবা পোশাকের পরিবর্তনের কোনো সুপারিশ করবে না জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে আমরা কোনো আলোচনাই করিনি। তবে পুলিশকে কীভাবে আরও জনবান্ধব করা যায় এসব বিষয় নিয়েই আমরা বিস্তারিত সুপারিশ করেছি। আমাদের মতো গরিব দেশে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করা কোনোভাবেই জরুরি ছিল না। পোশাক পরিবর্তন এটা একটা ধান্দাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। এদিকে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের দাবি করা হয়। তারা বলছিলেন, গুম, খুনসহ জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ পুলিশের হাতে লেগে আছে। পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ পুরো দেশের মানুষ। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৩ অক্টোবর এই বাহিনীর সংস্কারের জন্য পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
জানা গেছে, নতুন পোশাক নিয়ে খোদ পুলিশেরই অনেক সদস্য তাদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের ইউনিফর্ম অনেকটাই মিলে যাওয়ায় একই ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছেন ডিএনসির সদস্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, জুলাই আগস্টে ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য পুলিশের ওপর এখনো অনেকে ক্ষুব্ধ। তাদের আশঙ্কা একই পোশাকের কারণে ওই ক্ষোভের শিকার হতে পারেন তারাও। অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু পোশাক পরিবর্তন করলেই বাহিনীর আচরণে অর্থবহ পরিবর্তন আসবে না। আবার নতুন পোশাকের রং নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। নতুন পোশাকে পুলিশকে দূর থেকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদাই করা যায় না। তিনি আরও বলেন, কার স্বার্থে হঠাৎ করে এত খরচের আয়োজন করা হলো তা নিয়েও অনেক আলোচনা হচ্ছে। তবে পুলিশের নতুন পোশাকের পক্ষে মত দিয়েছেন সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে কিছু পুলিশ সদস্য ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক নানা অপরাধে জড়িয়েছেন। জনগণের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। সাধারণ জনগনের সঙ্গে তাদের অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই নতুন পোশাক আনা প্রয়োজন ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু পোশাক পরিবর্তন করলেই হবে না। ফোর্সের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ এবং প্রেষণার ব্যবস্থা করা। জানা গেছে, স্বাধীনতার পর দুই দফায় পুলিশের পোশাক পরিবর্তন হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা খাকি রঙের পোশাক ব্যবহার করেছেন। যদিও পুলিশের একই খাকি রং ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছিল। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ অফিসার স্যার হ্যারি লুমসডেনের পরামর্শে, পুলিশের ইউনিফর্মটি হালকা হলুদ এবং বাদামি রঙে রাঙানো হয়েছিল। তারপর চা পাতা, পানি ব্যবহার করে সুতির কাপড়ের রং রঞ্জকের মতো তৈরি করে ইউনিফর্মের ওপর লাগানো হতো। যার ফলে পোশাকের রং খাকি হয়ে যায়। সেই বছরই পুলিশে খাকি রঙের পোশাক গৃহীত হয়। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে। সেই বছর পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এমনকি ২০০৯ সালেও কিছুটা পরিবর্তন আসে।
২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য বেশ কয়েকটি পোশাকের ট্রায়ালও হয়। তারপরও নানা কারণে নতুন পোশাক পায়নি বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা।
বিজিবির নাম এবং পোশাক পরিবর্তনে সুপারিশ করবে না কমিশন : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নাম এবং পোশাক পরিবর্তনের কোনো সুপারিশ করবে না জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন।
এ বিষয়ে কমিশনের প্রধান তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, নাম এবং পোশাক পরিবর্তনের সুপারিশ করতে আমরা যাব না। বারবার নাম এবং পোশাক পরিবর্তন করাটা ঠিক না। কারণ পোশাক এবং নাম পরিবর্তন নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তৎকালীন হাসিনা সরকারের সময় বিজিবি স্বাধীনভাবে সীমান্তে কাজ করতে পারেনি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সময়ে তো ভালোই কাজ করছে।