বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের অপহরণ করে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও নেওয়া হচ্ছে পণ হিসেবে। ভুক্তভোগী পরিবার, জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত ও বঙ্গোপসাগরে আরাকান আর্মি অপহরণ বাণিজ্যে নেমেছে।
বিজিবির দেওয়া তথ্যমতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আরাকান আর্মি ৩৫৭ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এর মধ্যে বিজিবির চেষ্টায় ১৮৯ জেলেসহ ২৭টি নৌযান ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। কাগজে কলমের বাইরে অপহণের শিকার হয়েছেন ৫ শতাধিক।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের টেকনাফ ব্যাটালিয়ন-২ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, বিজিবি সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তারপরও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে জেলেদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানান, অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে আমরা চেষ্টা করছি। তারা যেন মিয়ানমার সীমান্তে না যান, সে ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে। টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী নৌকা মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ জানান, আরাকান আর্মির সদস্যরা নাফ নদ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আশপাশ থেকে ট্রলারসহ ধরে নিয়ে যায়। মাছ ধরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
শাহপরীর দ্বীপের জেলে মাহমুদুল হক বলেন, আরাকান আর্মি তাকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অপহরণ করে ১৭ দিন আটকে রাখে। মুক্তিপণ হিসেবে আমার পরিবারের কাছ থেকে চাল, পিঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েছে। ট্রলার মালিক জাকির হোসেন বলেন, আমার ট্রলার নিয়ে ১৫ নভেম্বর আবদুর করিম মাঝিসহ ছয় জেলে সাগরে মাছ শিকারে যান। ১৮ নভেম্বর সকালে টেকনাফে ফেরার পথে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছালে ট্রলারটি ধাওয়া করে আরাকান আর্মি। ধরে নিয়ে যায় ট্রলারসহ জেলেদের। অনুসন্ধানে জানা যায়, আরকান আর্মির প্রধান টার্গেট নাফ নদ ও সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে এবং সীমান্তবর্তী পাহাড়ে লাকড়ি সংগ্রহ করতে যাওয়া লোকজন। তারা ছোট ও দ্রুতগামী স্পিডবোট বা ট্রলার নিয়ে নাফ নদের বাংলাদেশ জলসীমার কাছাকাছি এসে ওত পেতে থাকে। জেলেরা গভীর নদীতে গেলেই অস্ত্রের মুখে তাদের মিয়ানমার সীমান্তে নিয়ে যায়।
টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে যারা চাষাবাদ বা লাকড়ি সংগ্রহ করতে যান, তাদেরও কৌশলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও বুচিডং এলাকার দুর্গম পাহাড়ে আরাকান আর্মির অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। অপহৃতদের সেখানে মাটির গর্তে বা বাঁশ দিয়ে তৈরি খাঁচায় আটকে রাখা হয়। নির্যাতনের ভিডিও ইমো বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। শুরুতে তারা মুক্তিপণ হিসেবে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করলেও, পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী দরাদরি করে ১ থেকে ৩ লাখ টাকার মধ্যে রফা করে। টাকা ছাড়াও পণ হিসেবে ওষুধ, চাল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও নেয় তারা।