Image description

নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে, সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে গুলি, যাতে পরিকল্পনার ছাপ সুস্পষ্ট বলেই ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। আশপাশের কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই হচ্ছে হামলা; মৃত্যু নিশ্চিত করতে চলছে একাধিক গুলি।

সবার সামনে রাজধানীতে বেপরোয়া কয়েকটি অপরাধের ঘটনা চাঞ্চল্য তৈরির পর নানা জিজ্ঞাসা বাড়ছে। প্রকাশ্যে এমন খুনের নেপথ্যে কী, জড়িতইবা কারা, সেই জল্পনা ডালাপালা মেলছে।

সপ্তাহের ব্যবধানে এমন দুটি খুনের ঘটনার দিনকয়েকের মধ্যে অপরাধীদের ধরার তথ্য দিয়েছে পুলিশ। গুলি চালানো অস্ত্রধারীদের পাশাপাশি জড়িতদের খুঁজে পাওয়ার দাবি করছে। অপরাধীদের দ্রুতই ধরে ফেলা সম্ভব হলেও আগেই কেন খুনোখুনি ঠেকানো যাচ্ছে না- সেই প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে।

সবশেষ সোমবার পল্লবীতে থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যার ঘটনা রাজধানী ঢাকার বাড়তে থাকা অপরাধ চিত্রকে আবার সামনে এনেছে।

সেদিন ঠিক সন্ধ্যার মুহূর্তে প্রতিদিনকার মত নিজের ‘বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি’ দোকানে ছিলেন পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়া। জনসম্মুখেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন অস্ত্রধারী দোকানে ঢুকে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে করা হয় একাধিক গুলি।

এর সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার আরেক স্থান পুরান ঢাকার আদালত পাড়ার কাছে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুনকেও প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুই অস্ত্রধারী।

সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকায় প্রকাশ্যে দুটি হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সামনে এনেছে ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ বিষয়টি।

এর বাইরে মার্চে গুলশানে কেবল নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী সুমন মিয়া, বাড্ডায় বিএনপি নেতা ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী কামরুল আহসান সাধন হত্যা থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক এমন ‘আলোচিত’ হত্যাকাণ্ডের পেছনে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ‘দলীয় কোন্দল’ আর ‘ভাগাভাগির দ্বন্দ্বের’ তথ্য পাওয়ার কথা বলেছেন।

পুলিশের তথ্যই বলছে, চলতি বছরের গত ১০ মাসে ঢাকায় ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সে হিসাবে মাসপ্রতি গড়ে প্রায় ২০টি খুন হয়েছে।

কেন এত খুন

‘মূলত’ আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘঠিত বেশির ভাগ ঘটনাতেই ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’ নামের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে নতুন ‘সন্ত্রাসী গ্রুপের’ বিষয়ও। এসব ঘটনার ‘হোতাদের’ অনেকে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের পর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই একাধিক মামলার আসামি। এর ফলে ঘটনার আগেই তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে না পারা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সক্ষমতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, ‘তথ্য পেলে’ আগেই মামলার আসামি বা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য আমাদের কাছে আসলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।

“আগেও অনেককে গ্রেপ্তার করছি, যাদের বিষয়ে তথ্য পাচ্ছি তাদেরকে গ্রেপ্তার করছি।”

বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুলিশ উদঘাটন করেছে দাবি করে পুলিশ কর্মকর্তা তালেবু বলেন, “খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার হচ্ছে।”

তবে রাজধানীতে একের পর এক ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ কারণে বর্তমান পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই বলে মনে করছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।

তিনি বলেন, টার্গেট কিলিংয়ের যারা হোতা বা যারা এর পেছনে যারা রয়েছে, তারা মনে করছে এখন এ ধরনের অপরাধের ‘অনুকূল সময়’। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও কিছু ক্ষেত্রে সেটি ‘অস্পষ্ট’, যার ফলে টার্গেটকিলিংসহ আরো অন্যান্য অপরাধগুলো বাড়বে।

কোনো কোনো ঘটনাতে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে ‘আধিপত্য বিস্তার কিংবা দখল বাণিজ্যের’ বিষয়কে সামনে এনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক।

তার ভাষ্য, “অন্য দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তো আছেই। নিজ দলের মধ্যেও অসংখ্য গ্রুপিং রয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অর্থ আয় এবং এগুলোর ভাগ বাটরা কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের কারণে খুনগুলো হচ্ছে।”

খুনের ঘটনার এই পরিসংখ্যানকে ‘অস্বাভাবিক’ দেখছেন না এবং তিন বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটি ‘কমেছে’ বলে জানিয়েছেন ডিএমপির ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “কিছু কিলিং…এটা হবেই এটা সোসাইটির ব্যবস্থা। আমরা যেটা পারছি ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ডে রাখছি। এটা হয়তো আমাদের অপারেশনের জন্যই হচ্ছে। তবে এটা আমরা অবশ্যই চাইব জিরোতে নেমে আসুক।

“আমাদের স্ট্যাটিক্স বলে আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। গত তিন বছরের স্ট্যাটিক্স যেটা বলে সেই তুলনায় কিলিং বাড়ে নাই, বরং কমছে। এটা দিয়ে ব্যার্থতা বলা যাবে না।”

যুবদল নেতা হত্যায় একসময়ের ‘ঘনিষ্ট’ সন্ত্রাসীর নাম

বুকে, পিঠে, মুখে ও ঘাড়ে পরপর কয়েকটি গুলিতে গত সোমবার মুহূ্র্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায় পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব কিবরিয়াকে; হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিবরিয়াকে হত্যার ঘটনায় সব মিলিয়ে ১৮ রাউন্ড গুলি করে অস্ত্রধারীরা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ মফিজুর রহমান মামুনের নাম এসেছে, যার সঙ্গে একসময় চলাফেরা ছিল কিবরিয়ার।

কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব এর পেছনে ‘রাজনৈতিক বিরোধ ও আধিপত্যের’ বিষয়টি সামনে এনেছেন।

শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ‘এখনই নিশ্চিত না’ হলেও র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তথ্য নাই। তবে আমরা অনুমান করতে পারি তার উপর থেকেও ইন্ধন থাকতে পারে।”

হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন জনি ভূইয়া (২৫) নামে একজনকে ধরে পুলিশে দেয়। জনি এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

 

 

আর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার মনির হোসেন ওরফে সোহেল ওরফে পাতা সোহেল এবং মো. সুজন ওরফে বুকপোড়া সুজনকে বৃহস্পতিবার চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

গোলাম কিবরিয়া হত্যা মামলার এজাহারে মনিরকে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে। ১৮ মামলার আসামি সুজনকে ‘সন্দেহভাজন’ বলেছে র‌্যাব।

একসময় কিবরিয়ার সঙ্গে মামুনের ‘সখ্যতার’ বিষয়টি সামনে এনে র‌্যাব কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, “এর আগে গোলাম কিবরিয়ার যাদের সঙ্গে সখ্য ছিল, রাজনৈতিক মেরুকরণের পরে তাদের বিরদ্ধে তিনি কাজ করছিলেন। বিশেষ করে এলাকায় চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারিতে গোলাম কিবরিয়ার সমর্থন ছিল না। হয়তো এ কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।”

হত্যাকাণ্ডে ‘অপরাধজগতের সংযোগ’ রয়েছে কি না, বাকিদের গ্রেপ্তারের পর জানা যাবে বলেও ভাষ্য তার।

ঘটনার পরদিন কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দীনা ৫ জনের নামে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, নাম আসা সবাই পল্লবীর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ ও ভাড়াটে খুনি।

পুলিশ বলছে, জনি ভূঁইয়া, সোহাগ ওরফে কাল্লু ও রোকন দোকানে ঢুকে গুলি চালায়। যাদের মধ্যে জনিকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকি দুইজন এখনও পলাতক রয়েছেন।

ঘুরে ফিরে আসছে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’ নাম

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সরকার বদলালে অগাস্টে পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’ অনেকেই জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ছাড়া পেয়ে অনেকেই আত্মগোপনে গেছেন, কারও কারও দেশ ছাড়ার খবরও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বিভিন্ন গ্রুপের ‘কোন্দলে’ সেসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে নাম আসার কথা বলছে পুলিশ।

বছরের শুরুতেই গত ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে বাবু নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার পর পুলিশ বলেছে, চিহ্নিত ‘সন্ত্রাসী’ বাবু ‘ব্লেড বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ঢাকার আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সুমন শিকদার ওরফে মুসার নাম এসেছে।

মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ‘প্রধান পরিকল্পনাকারী’ মুসাকে ওমান থেকে ফিরিয়ে এনেছিল ডিবি। সরকার পরিবর্তনের ৫ মাসের মাথায় গত ৩ জানুয়ারি জামিনে বের হন মুসা, এর কিছুদিন পরেই পল্লবীর হত্যাকাণ্ডে আবারও মুসার ‘সংশ্লিষ্টতার’ কথা জানাল পুলিশ।

বাবু খুনের পর পুলিশ জানিয়েছিল, পল্লবী এলাকার আধিপত্য বিস্তারের জেরে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ মফিজুর রহমান মামুন গ্রুপের সঙ্গে মুসা গ্রুপের ‘দ্বন্দ্বের’ জেরে খুন হয়েছিলেন বাবু। সবশেষ সোমবার যুবদল নেতা কিবরিয়া হত্যার পেছনে এল মফিজুর রহমান মামুনের নাম।

কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় মনির হোসেন ওরফে সোহেল ওরফে পাতা সোহেল ও মো. সুজন ওরফে বুকপোড়া সুজনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছে, পাতা সোহেল এই হত্যাকাণ্ডের ‘নির্দেশদাতা এবং পরিকল্পনাকারী’।

এ ঘটনায় মামুনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাব- ৪ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেছেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তথ্য নাই। তবে আমরা অনুমান করতে পারি তার উপর থেকেও ইন্ধন থাকতে পারে।”

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে গত ১০ জানুয়ারি ‘মাল্টিপ্লান সেন্টারের’ সামনে কম্পিউটার ব্যবসায়ী এহতেসামুল হক ও ওয়াহিদুল হাসান দিপুকে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে।

এ ঘটনায় এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনসহ ১০ জনের নাম দিয়ে ও অচেনা আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করে নিউ মার্কেট থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, আসামিরা ৫ অগাস্টের পর বিভিন্ন সময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসায়ীদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দেওয়া হত।

ইমন গত বছরের ১৬ আগস্ট জামিনে মুক্তি পান। তার একদিন আগেই দীর্ঘ দুই যুগ পর জামিনে বের হয়ে আসেন আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, যিনি গত ১০ জানুয়ারি হামলায় আহত দীপুর ভাই।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ হোসাইন মিথুনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলেছিল, ছাত্রদল নেতা মিথুন, সন্ত্রাসী ইমনের অনুসারী। যিনি ইমনের হয়ে ধানমন্ডি এলাকার চাঁদাবাজির অর্থ আদায় করতেন।

ইমন বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এলাকায় ‘আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে’ কেন্দ্র করে পিচ্চি হেলাল ও ইমন গ্রুপের দন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ মাল্টিপ্লান সেন্টারের সামনের ওই ঘটনা।

গত ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত পাড়ার কাছে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুনকে হত্যার পরেও এসেছে ইমনের নাম।

দুই বছর আগেও মামুনকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে হত্যাচেষ্টায় ইমন জড়িত থাকার কথা জানিয়েছিল ডিবি, এর ধারাবাহিকতায় এবার হত্যাকাণ্ডের পেছনেও এই সন্দেহের কথা বলা হয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তরফে।

মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তারও একই সন্দেহের কথা জানিয়ে বলেছিলেন, তার স্বামীকে হত্যার পেছনে ‘ইমনের হাত’ থাকতে পারে।

যদিও এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিকভাবে ইমনের সংশ্লিষ্টতার কথা না বললেও ডিএমপি ডিবি প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সানজিদুল ইসলাম ইমন ও নিহত মামুন ছাড়াও তাদের গ্রুপে রনি নামে আরেকজন ছিলেন। মামুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে রনি এই হত্যার ‘পরিকল্পনা’ করেন।

হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ রনির পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রনি এক সময়ে মুদি দোকানি ছিলেন। বর্তমানে কাফরুলের বাসিন্দা ও পুলিশের খাতায় ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’। ইমন ও মামুনের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা তারা নিয়ন্ত্রণে নেয়।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, রনি পলাতক, তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

“প্রাথমিকভাবে অপরাধজগতেকর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে এই হত্যার ঘটনা মনে করা হলেও রনিকে গ্রেপ্তারের পর জানা যাবে হত্যার মূল কারণ এবং এর সাথে ইমনের কোনো যোগসূত্র আছে কি না।”

এছাড়া দীর্ঘ ১৯ বছর পর গত ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সরকারের তালিকায় থাকা আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম।

সরকার বদলের পর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন মিরপুরের আব্বাস আলী, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। কারাগারে থেকেই বিভিন্ন এলাকার ‘অপরাধ জগতের’ নিয়ন্ত্রণ করে আসা ব্যক্তিদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে তথ্য দিচ্ছে পুলিশ।

নেপথ্যে নতুন গজিয়ে ওঠা গ্রুপের আধিপত্যের জের

পল্লবীতে যুবদল নেতা কিবরিয়াকে হত্যার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তারের পর তারা মিরপুরকেন্দ্রীক গড়ে ওঠা ‘ফোর স্টার গ্রুপের’ সদস্য বলে দাবি করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব বলছে, ফোর স্টার গ্রুপ মিরপুরকে চারটি ভাগে ভাগ করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।

র‍্যাব- ৪ অধিনায়ক মাহবুব আলম বলেন, “মিরপুরে যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে, এর পেছনে আমরা ফোরস্টার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছি। ফোর স্টার মানে চারজন স্টার। সন্ত্রাসী মামুন, কিলার ইব্রাহিম, সন্ত্রাসী শাহাদাত, সন্ত্রাসী মুক্তার এদের ছত্রছায়ায় গ্রুপটি পরিচালিত হয়। এদের নির্দেশে মিরপুরে যেসব অরাজকতা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করা হয়, তাদের একটা মদদ রয়েছে বলে জানতে পেরেছি।”

কিবরিয়া হত্যায় গ্রেপ্তার পাতা সোহেল ও সুজন ‘ফোর স্টার গ্রুপের’ ইব্রাহিম এবং মামুন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কার্যক্রমে ‘লিপ্ত ছিল’ বলে ভাষ্য তার।

চলতি বছরের ২০ মার্চ গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সুমন মিয়া নামে এক ডিস ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ খুনের ঘটনা তদন্ত ও বিশ্লেষণ করে পুলিশ বলেছিল, সুমন বাড্ডা, গুলশান ও মহাখালী অঞ্চলের অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী রবিন-ডালিম গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

সরকার পতনের পর রবিন-ডালিম গ্রুপের হয়ে সুমন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। চাঁদাবাজি, মাছের আড়ত দখল, কেবল টিভি সংযোগ-ইন্টারনেট ব্যবসা, জমি দখলসহ নানা অপরাধে সক্রিয় ছিলেন সুমন।

এ অঞ্চলের আধিপত্য বিস্তারে রবিন-ডালিম গ্রুপ ছাড়াও জিসান গ্রুপ ও মেহেদী গ্রুপ সক্রিয় থাকার তথ্য দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই তিন সন্ত্রাসী গ্রুপের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে।

ওই ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় খুনের ঘটনায় সাঈদ ওরফে বড় সাঈদ ও মামুন ওরফে বেলালকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব-১ এর এএসপি সালমান নূর আলম বলেছিলেন, “মেহেদী নামের এক সন্ত্রাসী ওয়াসির মাহমুদ সাঈদের মাধ্যমে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে বিগত কয়েক বছর ধরে গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছিল। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মেহেদী পালিয়ে যায় এবং তার বাহিনীর সদস্য সাঈদের মাধ্যমে গুলশান ও বাড্ডা এলাকার চাঁদা সংগ্রহ করে।”

গুলশান এলাকার বিভিন্ন মার্কেটের দোকানে চাঁদাবাজির বিষয় নিয়ে মেহেদী গ্রুপের সঙ্গে রবিন গ্রুপের সুমনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই বিরোধের কারণে মেহেদী গ্রুপের প্রধান মেহেদীর নির্দেশে সুমনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে সাঈদ। হত্যার ঘটনার ৮-১০ দিন আগে সুমনকে হত্যার উদ্দেশ্যে বেলাল ও মামুনের নেতৃত্বে মেহেদী গ্রুপের ৪-৫ জন সন্ত্রাসী দিয়ে একটি কিলার গ্রুপ গঠন করে সাঈদ।

এ ঘটনার মাস দুয়েকের পর ২৫ মে বাড্ডা গুদারাঘাট এলাকার চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বাড্ডা এলাকায় ডিস, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ‘ধারণার কথা’ জানিয়েছিল পুলিশ।

এ হত্যাকাণ্ডের পেছনেও ডিবি পুলিশ রবিন-ডালিম গ্রুপ, জিসান গ্রুপ ও মেহেদী গ্রুপের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বের’ বিষয়টি সামনে আনে গত অগাস্টে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, ইন্টারনেট, ডিশ ব্যবসা, ফুটপাত ও মার্কেটের চাঁদাবাজির দোকানসহ বিভিন্ন বিষয় ‘দ্বন্দ্বের জেরে’ সাধনকে হত্যার নির্দেশনা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মেহেদী।

আলোচনায় ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ১০ মাসে ঢাকায় ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের তথ্য দেওয়া হলেও হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩৭১টি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের ঘটনায়ও এই সময়ে মামলা হওয়ায় সাধারণত মামলার সংখ্যা বেশি।

মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩৩৯টি হত্যা মামলা হয়। আর এ বছর প্রথম ১০ মাসে মামলা হয়েছে ৩০২টি। এর মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অগাস্টেই হত্যা মামলা হয় ১১৯টি।

অপরদিকে ২০২৩ সালে মোট হত্যা মামলা হয় ১৬৫টি, প্রথম ১০ মাসে এই সংখ্যা ছিল ১৪৪টি।

এরমধ্যে চলতি বছরে প্রথম ১০ মাসে সারাদেশে মোট ৬৮টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে ‘রাজনৈতিক কারণ’ থাকার কথা বলেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন।

এরমধ্যে ঢাকায় অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও এর পেছনে ‘রাজনৈতিক কারণের’ কথা বলেনি পুলিশ।

তবে চলতি বছরে ঢাকায় হওয়া কোনো হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ‘রাজনৈতিক কারণ’ নেই বলে দাবি করেছেন ডিএমপির উপকমিশনার তালেবুর রহমান।

“পলিটিক্যাল মার্ডার নামে অপরাধ বিজ্ঞানে কোনো মার্ডার নাই। যেগুলো হয়েছে তার মধ্যে এমন কোনো হত্যাকাণ্ড মনে পড়ছে না।”

বাইরে থাকা ‘অবৈধ অস্ত্র’ নিয়ে ঝুঁকি

চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর পুলিশের লুণ্ঠিত বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশের সবশেষ হিসাব বলছে, এখনো এক হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ রাউন্ড গোলাবারুদ বেহাত অবস্থায় রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার।

মিরপুরে যুবদল নেতা কিবরিয়া খুনের পর এসব বাইরে থাকা অস্ত্রের বিষয়টি আবার সামনে এনেছেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মাহবুব আলম। এগুলো উদ্ধোরে প্রতিদিন চেষ্টা চলছে বলেও তুলে ধরেন তিনি।

“যে পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র বাইরে আছে, সেটা দিয়ে ঢাকার মতো একটা জনবহুল এলাকায় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিষ্ক্রিয় করাটা কঠিন। আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছি।”

সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়েও আলোচনা

কিবরিয়া হত্যায় ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ পাতা সোহেল সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাব কর্মকর্তা মাহবুব।

জামিনে বের হয়ে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ‘পরিকল্পনা করেন’ এবং শুটারদেরকে ‘অর্থ সরবরাহ’ করেন বলে ভাষ্য তার।

তবে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থাকলেও আইনী প্রক্রিয়া তাদের ‘হাত নেই’, যোগ করেন তিনি।

চলতি সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোর কমিটির সভায় আইনশৃঙ্থলা নিয়ন্ত্রণে না আসার বিষয়ে ‘গণহারে’ জামিন দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

কী করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না দেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক।

তিনি বলেন, “নামকা ওয়াস্তে ব্যবস্থা না, একদম দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা বলতে আমরা যা বুঝি, সেই ব্যবস্থাটা গ্রহণ করতে হবে। অপরাধী বা অভিযুক্ত তার রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে আমরা লক্ষ্য করছি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নে অনেক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। এই অবস্থাটা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

“অর্থাৎ একজন অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পরে যিনি অভিযুক্ত তাকে আইনের দৃষ্টিতে তার যে পরিচয় আছে সেই পরিচয়ের আলোকে তাকে বিবেচনা করতে হবে।”

ডিএমপির ডিবিপ্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৫ অগাস্টের পর কিছু নামকরা শীর্ষ সন্ত্রাসী, অনেক দাগী আসামি ভেতরে ছিল, বের হয়ে গেছে। আমরা এখন নিয়মিত তাদের কার্যকলাপ অর্গানাইজড হচ্ছে কি না, আবার পুরাতন অবস্থায় ফিরে আসছে কি না এগুলো নিয়ে কাজ করছি। ইনশাল্লাহ জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য যেটুকু করা দরকার আমরা করব।”