Image description
ওসি সায়েদ ও এএসআই বিশ্বজিৎ ছয়টি লাশ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেন

‘গত বছর ১৫ আগস্ট থানায় গিয়ে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলি জমা দেওয়ার সময় জানতে পারি, পিকআপ ভ্যানে ওঠানো লাশগুলো ওইদিন ওসি সায়েদ স্যার ও বিশ্বজিৎ মিলে পেট্রোল ঢেলে আগুনে জ্বালিয়ে দেন।’

কথাগুলো আশুলিয়া থানার তৎকালীন এসআই শেখ আবজালুল হকের। আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশ ভ্যানে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল জবানবন্দি দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন তিনি। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ এ এই মামলায় প্রসিকিউশনের ২৩তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন এ মামলার আসামি ও রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) আবজালুল। জবানবন্দি শেষে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান। পরে তাকে জেরা শুরু করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। জেরা অসমাপ্ত থাকায় আজ পুনরায় দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামের জবানবন্দি শেষ হয়েছে। তাকে আসামি পক্ষের আইনজীবীদের জেরার জন্য ২৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ পুলিশের আট সদস্য আসামি। এর মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ও অন্য চারজন পলাতক রয়েছেন।

আশুলিয়া থানার সামনে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনার মামলায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া ৩৪ বছর বয়সি পুলিশের সাবেক এসআই আবজালুল জবানবন্দির শুরুতে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পুলিশে এসআই হিসেবে যোগদান করি। পরে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা রেঞ্জের আওতাধীন ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানায় যোগদান করি। সাভার ও আশুলিয়া থানা নিয়ে একটি সংসদীয় আসন। জবানবন্দিতে আবজালুল বলেন, ২০২৪ সালে জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালীন আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ স্যারকে মোবাইলে আন্দোলন দমনসহ বিরোধীদের গ্রেপ্তার করতে মাঝেমধ্যে নির্দেশনা দিতেন স্থানীয় এমপি সাইফুল। এসব নির্দেশনা অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করতেন ওসি স্যার। তিনি বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানাধীন পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে আমি সকালে থানায় পৌঁছাই। এরপর অস্ত্রাগার থেকে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলি নিয়ে থানার পশ্চিম পাশে দায়িত্বে নিয়োজিত হই। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হেলার (হ্যান্ড মাইক) দিয়ে থানার সব কর্মকর্তা ও অধস্তনদের নিচে ডাকেন ওসি স্যার। সবার উদ্দেশে জুলাই আন্দোলনে শক্তভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এরপর অন্য ইউনিট থেকে আসা বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও ফোর্সদের নিয়ে বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যান তিনি। আমাদের দায়িত্ব ছিল থানার গেটে ও ভিতরে। দুপুর আড়াইটায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে ফোর্স নিয়ে থানায় চলে আসেন সায়েদ স্যার। জবানবন্দিতে রাজসাক্ষী আবজালুল    বলেন, থানায় আসার পর কিছু লোককে থানার পূর্ব ও পশ্চিম পাশে মোতায়েন করেন। ওসি স্যারের সঙ্গে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান স্যার, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার স্যার, পুলিশ পরিদর্শক (ডিবি) আরাফাত হোসেন স্যার, এসআই আবদুল মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই বিশ্বজিৎ, এএসআই কামরুল হাসান, কনস্টেবল মুকুল চোকদারসহ অন্য ইউনিট থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে থানার গেটে থাকেন। তিনি বলেন, বিকাল ৪টায় ছাত্র-জনতার একটি অংশ থানার দিকে বিজয় মিছিল নিয়ে আসে। ওই সময় ওসি স্যারের সরাসরি নির্দেশে এএসআই বিশ্বজিৎ ও অন্য ইউনিট থেকে আসা কয়েকজন পুলিশ সদস্য মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। তাৎক্ষণিক কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যান। সাক্ষী আরও বলেন, ঠিক তখনই ওসি স্যার ফোনে ‘স্যার স্যার’ বলে পায়চারি করছিলেন। পরে ওসি স্যারের নির্দেশে কয়েকজন পুলিশ সদস্য পড়ে থাকা লাশগুলোকে তিন চাকার ভ্যানে তুলে পুলিশের আরেকটি পিকআপভ্যানে ওঠান। ওই সময় সঙ্গে থাকা এসআই আবদুল মালেক ও এএসআই বিশ্বজিৎকে নিয়ে পরামর্শ করছিলেন ওসি স্যার। আমি তাদের কাছাকাছি গেলে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তখন আমার মনে হলো তারা লাশগুলো নিয়ে অন্য পরিকল্পনা করছিলেন। আমি কিছুটা নার্ভাস অনুভব করি। সিদ্ধান্ত নিই এখানে থাকা আমার ঠিক হবে না। আমি থানায় ঢুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে সিভিল পোশাকে পিস্তলটি প্যান্টের সামনের দিক দিয়ে গুঁজে সাধারণ মানুষের মতো থানা থেকে বের হয়ে যাই। পরে ফল বিক্রেতা কামালের সঙ্গে ভাড়া বাসায় উঠি। আবজালুল জবানবন্দিতে বলেন, এরপর ফজরের আজান পর্যন্ত ওই বাসা থেকে বেরিয়ে থানার পশ্চিম পাশে এস এ পরিবহনের গলি দিয়ে বাইপাইল হয়ে ভাড়া বাসায় যাই। ১৫ আগস্ট থানায় গিয়ে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলি জমা দিই। তখন জানতে পারি, পুলিশ যাদের হত্যা করে পিকআপে রেখেছিল, সেসব লাশ ওইদিনই ওসি সায়েদ স্যার ও বিশ্বজিৎ মিলে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন।

পরে তারা বিকাল সাড়ে ৫টায় থানা ছেড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান।

এই রাজসাক্ষী আরও বলেন, তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম স্যার, তৎকালীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান রিপন স্যার, সাভার (ক্রাইমস অ্যান্ড অপস) এডিশনাল এসপি (এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল্লাহিল কাফি স্যার, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল স্যারদের এ ঘটনা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। পরে আমি চলতি বছরের মে মাসে গ্রেপ্তার হই। তবে আমি শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কোনো ধরনের প্ররোচনা ও প্রলোভন ছাড়া এই মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য আবেদন করি। যেন ট্রাইব্যুনালকে এ মামলার বিষয়ে সত্য তথ্য দিয়ে বিচারকাজে সহায়তা করে শহীদ ভাইদের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারি। আমি শহীদ ভাইদের জন্য কিছু করতে না পারায় তাদের পরিবার ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।