৫৪ বছরের পেশাগত জীবনে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী গণমাধ্যমের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী। কখনো কখনো তিনি নিজেই ইতিহাসের উপাদান ও অধ্যায়। এ সময়ের মধ্যে তথ্যপ্রকাশের দায়ে তাকে একাধিকবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, জেলেও গিয়েছেন একাধিকবার। দেশ ছাড়তে হয়েছে, সাজাও হয়েছে।
যে তথ্য তার সম্পাদিত মানবজমিনে প্রকাশের দায়ে আদালত সাজা ঘোষণা করেন, সেই তথ্যের পক্ষে প্রমাণ হাজির করার পর পত্রিকার সম্পাদকের কেন জেল হলো, তা আজও তিনি জানেন না। সেই মামলার আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তিন সরকারের আমলে মানবজমিনে প্রকাশিত বহুল আলোচিত, দেশজুড়ে সাড়া জাগানো ও পাঠকনন্দিত তিনটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের উল্লেখ করে দুদিন আগে নিজের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে মতিউর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি ও পত্রিকাটি বারবার রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও আতঙ্কের শিকার হওয়ার কথা।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, একজন সম্পাদক যখন এ ধরনের তথ্য পাঠক-দর্শককে লিখে বা বলে জানান, এর নানা অর্থ থাকে। এর মধ্যে একটা অর্থ হচ্ছে ওই সম্পাদক ও তার প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সৃষ্ট ভয়-হুমকি-আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে আছে। বিষয়গুলো পাঠক-দর্শকের সঙ্গে তাই শেয়ার করেন। কোনো সংবাদমাধ্যম এমন পরিস্থিতিতে থাকলে মানে দাঁড়ায় এর সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী আচরণ করা হচ্ছে, বা প্রতিষ্ঠানটি এ জাতীয় হুমকির মধ্যে আছে।
বর্তমান সরকারের আমলেও অভিযোগের করাল গ্রাস থেকে মানবজমিন যে বাদ পড়েনি, তা মতিউর রহমান চৌধুরীর বক্তব্যে স্পষ্ট। গঠনমূলক সমালোচনা করায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে চোখ রাঙানো হচ্ছে পত্রিকাটিকে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের দাবি, মানবজমিন নিজেদের তৃতীয় সারির সংবাদমাধ্যমের মানহীনতার স্তরে নামিয়ে এনেছে। ঘুরেফিরে এর অর্থ দাঁড়ায়, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পাদক হিসেবে 'থার্ড গ্রেডের সাংবাদিক'।
প্রতিষ্ঠানতুল্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রেস সচিবের এই অশোভন মন্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। পত্রিকাটির বিরুদ্ধে প্রেস ফ্রিডমের অপব্যবহারের অভিযোগ করছে সরকারের উঁচু মহল। আবার সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশে 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা', বা 'সাংবাদিকতার জন্য মুক্ত পরিবেশ' নিশ্চিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারকে সমালোচনা করার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ মতিউর রহমান চৌধুরী এখনো প্রায়ই ছদ্মনামে লিখে থাকেন।
শুধু মানবজমিনেই নয়, 'সাপ্তাহিক জনতার চোখ' পত্রিকায়ও তিনি মূল নাম আড়াল করে ভিন্ন নামে লেখেন। এখন কেন তিনি ছদ্মনামে লেখেন? তিনি তো আওয়ামী লীগের আমলের সুবিধাভোগী সাংবাদিক, সম্পাদক তালিকার কেউ নন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করার নামে তার প্রশংসা তিনি করেননি। তাহলে রাজনৈতিক পালাবদলের পর দেশের সাংবাদিকতায় ভয়ের পরিবেশ কী কাটেনি?
মতিউর রহমান চৌধুরী বললেন, কোনো সরকারের আমলেই স্বস্তি ছিল না। বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। একপর্যায়ে মানবজমিনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। তখন অনেকেরই ধারণা ছিল, অন্য সংবাদমাধ্যমের মতো মানবজমিন আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবে। প্রমাণ দিতে পারবে না। কিন্তু মানবজমিন আদালতে দাঁড়িয়ে মামলা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে মানবজমিন একদিনের জন্যও আপস করেনি। এজন্য আট মাস দেশেই ফিরতে পারিনি। মামলা মোকদ্দমা তো ছিলই। পত্রিকার বিজ্ঞাপনও সংকুচিত করা হয়। শেখ হাসিনার পতনের তিনদিন আগেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় আমাকে। আজ অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকে প্রেস ফ্রিডমের কথা বলছেন।
তিনি বলেন, এমনকি যখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস মিডিয়ায় কার্যত নিষিদ্ধ ছিলেন তখনও মানবজমিন তার পাশে ছিল। তার বিরুদ্ধে বলা থেকে বিরত থাকার জন্য টকশো উপস্থাপনা বর্জন করেছিল কে খবর নিয়ে দেখুন। প্রাপ্তির জন্য মানবজমিন কিছু করে না।
তিনি বলেন, ২৭ বছর আগে এই পত্রিকাটির জন্ম। উপমহাদেশের প্রথম বাংলা ট্যাবলয়েড দৈনিক। ট্যাবলয়েড মানেই সেক্স-স্ক্যান্ডাল ও গুজবে পরিপূর্ণ থাকবে। যেমনটা হয় পশ্চিমা দুনিয়ায়। কিন্তু মানবজমিন অনেকটাই ব্যতিক্রম। শুরু থেকেই মানবজমিন সিরিয়াস পত্রিকা হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে।
গত ১৬ই নভেম্বর মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক মন্তব্য কলামে মতিউর রহমান এসব কথা বলেন। 'প্রেস ফ্রিডম এবং মানবজমিন' শিরোনামে প্রকাশিত এ লেখা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নানামুখী আলোচনা চলছে নেটিজেনদের মধ্যে। নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেন অংশ নিচ্ছেন আলোচনায়।
অনেকে বলছেন, প্রাজ্ঞ এই সাংবাদিক কেন প্রায়ই ছদ্মনামে লেখেন, এর কারণও জানা গেল তার এই লেখার মাধ্যমে। সরকারি রোষানল থেকে নিজের সহকর্মী ও মানবজমিনকে কিছুটা রক্ষার প্রয়াস থেকে, বা ঝামেলা এড়াতে তিনি ছদ্মনামে লেখেন।
প্রসঙ্গত, গত ২২শে মে মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে রাজনৈতিক ভাষ্য ‘প্রফেসর ইউনূস এখন কী করবেন’ মতিউর রহমান চৌধুরীর ছদ্মনামে (শান্তনা রহমান) প্রকাশিত হয়। 'জনতার চোখ' মানবজমিনের সহযোগী প্রকাশনা। এটি রাজনৈতিক ম্যাগাজিন।
গত বছরের ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। 'জনতার চোখ' আগেও প্রকাশিত হয়েছিল, শেখ হাসিনার গত সরকারের আমলে এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মতিউর রহমান চৌধুরী জনতার চোখে 'ছদ্মনামে' লিখতেন।
'প্রেস ফ্রিডম এবং মানবজমিন' শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনে মতিউর রহমান বলেন, পক্ষে না গেলেই প্রেস ফ্রিডম নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা কথা বলেন। মুহূর্তের মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেন। নানা ছবকও দেন। মামলা মোকদ্দমা তো আছেই। ক্ষমতা হারানোর পর এরাই আবার সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এটাই স্বাভাবিক। নতুন কিছু নয়। ৫৪ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছি।
তিনি বলেন, তিনটি অনুসন্ধানী রিপোর্টের কথা উল্লেখ করবো, যা বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে। সবার মনে আছে নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার প্রথম জমানায় ক্যাসেট কেলেঙ্কারির কথা। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তখন প্রেসিডেন্ট। একটি মামলা চলাকালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন কর্মরত বিচারপতির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। এর উপর ভিত্তি করে মানবজমিন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে।
তিনি বলেন, একটি রাজকীয় কেলেঙ্কারির খসড়া- শীর্ষক এই খবর নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন তদন্তের নির্দেশ দেন। এক পর্যায়ে মানবজমিনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়। তখন অনেকেরই ধারণা ছিল অন্য সংবাদমাধ্যমের মতো মানবজমিন আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবে। প্রমাণ দিতে পারবে না। কিন্তু মানবজমিন আদালতে দাঁড়িয়ে মামলা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আদালত প্রমাণ জানতে চাইলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মানবজমিন আদালতে ক্যাসেট হাজির করলো। যেখানে ছিল এরশাদ-লতিফুর রহমানের কথোপকথন।
তিনি লেখেন, আদালতের কার্যক্রম এক ঘণ্টার জন্য মুলতবি করে বিচারপতিরা ক্যাসেটের বয়ান শুনলেন। সাথে সাথে বিচারপতি লতিফুর রহমান পদত্যাগ করলেন। মামলায় নাটকীয় মোড়। এরশাদের ছয় মাসের জেল হলো। মানবজমিনের প্রধান সম্পাদকের জেল হলো এক মাসের, সম্পাদকের একদিনের। প্রমাণ হাজির করার পর পত্রিকার সম্পাদকের কেন জেল হলো, তা আজও জানি না। আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে দুই অভিযুক্ত এরশাদ এবং লতিফুর রহমান না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় ঘটনাটি (প্রতিবেদন) সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন নিয়ে। এটাও শেখ হাসিনার শাসনের সময়কার ঘটনা। প্রায় ১৪ বছর হারিছ চৌধুরী ঢাকার পান্থপথে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের পরিচয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। হাসিনার প্রশাসন তাকে দেশে-বিদেশে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। গোয়েন্দারা এজন্য একাধিকবার বিদেশ সফরও করেন।
তিনি বলেন, এরপরের ঘটনাটি অতি সাম্প্রতিক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে বিতর্ক যখন চারদিকে, তখন মানবজমিনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট সামনে আসে। মানবজমিন প্রমাণ করে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। ব্যাপক তোলপাড় হয় দেশে-বিদেশে।
তিনি জানান, পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে। যা এই মুহূর্তে বলে নতুন কোনো বিতর্কের জন্ম দিতে চাই না। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, মানবজমিন এবার ধরা খাবে। পরিস্থিতি এমনই ছিল। কিন্তু সত্যের জয় ঠেকায় কে! শত চেষ্টা করেও মানবজমিনের কণ্ঠরোধ করা যায়নি। এটা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।