Image description
 
ঈশ্বরদীতে একটি মহিষ চুরি ঠেকাতে গিয়ে নিজের মূল্যবান জীবন হারালেন আশিকুর রহমান পিন্টু (৪৫)। টানা ৯ দিন আইসিইউতে থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এই সৎ ও দায়িত্বপরায়ণ গেটকিপার। সোমবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিছানায় নিথর দেহে পরিণত হলো তাঁর সমস্ত সাহসিকতা।
 
নিহত পিন্টু লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নের কৈকুন্ডা গ্রামের মৃত নুর সালাম সরদারের ছেলে। কর্মস্থল দাশুড়িয়া রেলগেট— যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন তিনি। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনই শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিল তার জীবন।
 
গত ৯ নভেম্বর ভোরে সবাই যখন অন্ধকারে ঘুমে মগ্ন, তখন দাশুড়িয়া রেলগেটে দায়িত্ব পালন করছিলেন পিন্টু। ভোর চারটার দিকে নীরবতা ভেদ করে তিনি টের পান অস্বাভাবিক নড়াচড়া। রেলগেটের পাশে স্থানীয় মনির উদ্দিনের গোয়ালঘর থেকে দুর্ধর্ষ কিছু চোর একটি মহিষ টেনে এনে রেলগেট এলাকার কাছে দাঁড়ানো একটি পিকআপে তোলার চেষ্টা করছে।
 
কর্তব্যপরায়ণ পিন্টু একটু দেরি না করে এগিয়ে যান। তার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে চোরেরা মুহূর্তে বদলে যায় হিংস্র পশুতে। এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষির পাশাপাশি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিন্টুকে আঘাত করতে থাকে তারা। একা, নিরস্ত্র, নিজের দায়িত্ব আর সততাকে ঢাল করে দাঁড়িয়ে থাকা পিন্টু একসময় রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
 
তার করুণ চিৎকার শুনে স্থানীয়রা ছুটে এলে চোরেরা মহিষটি ফেলে পিকআপ নিয়ে পালিয়ে যায়। রক্তে মাখামাখি পিন্টুকে প্রথম ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেখান থেকে ঢাকায় আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়।
 
দিনের পর দিন আইসিইউতে পড়ে থেকেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। অবশেষে চিকিৎসকরা যখন সব আশা হারিয়ে তাকে ঈশ্বরদী ফিরিয়ে আনেন, তখনও হয়তো তিনি ভিতরে ভিতরে জীবনের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা— সোমবার সন্ধ্যায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পাকশী হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এজাজ আহমেদ গভীর শোক জানিয়ে বলেন, “দায়িত্ব পালনকালে এমন মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। চোরদের শনাক্তে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি।”
 
পারিবারিক সূত্র জানায়, মৃত্যুকালে পিন্টু স্ত্রী, ১ ছেলে, ২ মেয়ে, আত্নীয়-স্বজন ও প্রচুর গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় উপজেলার লক্ষিকুন্ডা কৈকুন্ডায় তার নামাজে জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী গোরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
 
সচেতন মহলের অনেকেই বলছেন, পিন্টুর মৃত্যু শুধু তার পরিবারকেই শোকের সাগরে ভাসায়নি, স্তব্ধ করেছে পুরো ঈশ্বরদীকে। একটি মহিষ বাঁচাতে গিয়ে যে মানুষটি নিজের জীবনই হারালেন, তার সাহসিকতা, সততা ও ত্যাগের গল্প আজ মানুষের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে। এই মৃত্যু শুধু একজন মানুষকে হারানো নয়—এ যেন আমাদের সমাজ থেকে আরেকটি সততা, আরেকটি দায়িত্ববোধ, আরেকটি মানবিকতা।
ওহিদুল ইসলাম সোহেল
ঈশ্বরদী (পাবনা)