ভারতে পালিয়ে থাকা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ফাঁসির সাজা শুনে তার নিজ দেশে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল হলেও প্রতিবেশী দেশের রাজধানী নয়াদিল্লি ও কলকাতার প্রশাসন এবং পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা হতাশ। ট্রাইব্যুনালটি হাসিনারই বানানো হলেও এটাকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ আখ্যা দিলেন এখানকার বুদ্ধিজীবীরা।
ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার হাসিনাকে রক্ষায় নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও দেশটির বামপন্থিদের মুখে ভিন্ন সুর। কেউ কেউ বলছেন, খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক। কবি ও সম্পাদক অতনু সিংহ বলেন, শিগগিরই আওয়ামী লীগ প্রধানকে ফেরত পাঠানো দরকার। চলচ্চিত্র পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদারেরও একই বক্তব্য। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকারের এত মাথাব্যথা, হাসিনাকে ফেরাক এবার!
এদিকে হাসিনার ফাঁসির রায় শোনার পর আরো বিষণ্ণ কলকাতায় পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা। নিউটাউনের শাপুরজিতে দলটির অস্থায়ী কার্যালয়ে গতকাল সোমবার বিকাল ৪টায় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও কেউ সেখানে যাননি। তারা শরীর খারাপ জানিয়ে বৈঠকে হাজির হননি বলে জানা গেছে।
হাসিনা সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বৈঠকে উপস্থিত হননি। ফলে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন, যত হুমকি-ধমকি দেন না কেন, আসলে ভেতরে ভেতরে তারা বেশ শঙ্কিত বলে সচেতন মহলের ধারণা। তাদের ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত এটা একরকম স্পষ্ট হয়েছে। তবে তারা আশা করছেন, ভারত নতুন কোনো ন্যারেটিভ বানিয়ে তাদের প্রাসঙ্গিক করে তুলবে। সেকাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। হাসিনাকে ফেরানো যাবে না বলে, নানা আইনি জটিলতার কথা বলছে কলকাতা ও দিল্লি।
মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনাকে ফাঁসির সাজা দেওয়ার পর তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমানে ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ প্রধানকে নয়াদিল্লি আদৌ প্রত্যর্পণ করবে কি না, তা নিয়ে তীব্র জল্পনা শুরু হয়েছে। কারণ, বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আইনি জটিলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আইনি বাধ্যবাধকতা ও চুক্তির শর্ত
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গত অক্টোবরে স্পষ্ট করেন যে, এটি একটি ‘বিচার বিভাগীয় ও আইনি প্রক্রিয়া’ এবং এর জন্য দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা প্রয়োজন। তার মন্তব্য ছিল, ‘আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি এবং বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করার জন্য তৈরি।’
এর আগে, বাংলাদেশের চিঠি পাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালও জানিয়েছিলেন, তারা চিঠির বৈধতা যাচাই করছেন।
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কয়েকটি শর্তের কারণে ভারত হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য নয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার বলেন, ‘ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয়। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি থাকলেও সেখানে এমন কিছু শর্ত আছে যার জন্য নয়াদিল্লি সেটি মানতে বাধ্য নয়।’
একই মত পোষণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়িও জানান যে, চুক্তির শর্তাবলির কারণেই ভারত প্রত্যর্পণে বাধ্য নয়।
জীবনের ঝুঁকি ও রাজনৈতিক চরিত্র
বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তির দুটি মূল দিক ভারতকে প্রত্যর্পণে বিরত রাখতে পারে। প্রথমত, ২০১৩ সালের চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অপরাধটির যদি রাজনৈতিক চরিত্র থাকে, তবে প্রত্যর্পণ করা হবে না। দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সোমবারের রায়ের পর বাংলাদেশে হাসিনার প্রাণ সংশয়ের সম্ভাবনা আছে। তাই ওই চুক্তিতে থাকা শর্ত অনুযায়ী ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য নয়।’
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরিন্দম দাস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দিকটি ব্যাখ্যা করে জানান, ‘যদি কোনো দেশে কারও জীবনের ঝুঁকি থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া দেশ তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়। হাসিনার ক্ষেত্রেও এই আইনের কথা তুলে ধরতে পারে ভারত।’
একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, দেশে না থাকার জন্য যদি হাসিনা রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যেতে বাধা পান, তবে তা-ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে যে, বিচারের নেপথ্যে যদি সৎ কোনো উদ্দেশ্য না-থাকে, তা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে না। হাসিনাকে ফেরত না দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব যুক্তি প্রধান হাতিয়ার হতে পারে নয়াদিল্লির।