গুলি করে হত্যার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত ১০ দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে চারটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় ব্যববহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে গত ১১ নভেম্বর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে সন্ত্রাসী তারেক সাইদ মামুনকে হত্যা এবং চট্টগ্রামে আরেক সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলাকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
সন্ত্রাসীরা এত আগ্নেয়াস্ত্র কোথায় পাচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে সূত্র বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া সহস্রাধিক অস্ত্র এখনো উদ্ধারের বাইরে রয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত দিয়েও দেশে অস্ত্র প্রবেশের তথ্য মিলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সীমান্তের অন্তত ১৮টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।
লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এমন তিনটি অস্ত্র এখনো উদ্ধারের বাইরে। এই তিনটি অস্ত্র উদ্ধারে সন্ধানদাতাকে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার। অস্ত্র তিনটির নাম লাইট মেশিনগান (এলএমজি)। সূত্র জানায়, এই এলএমজি যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানা ও কারাগার থেকে পাঁচ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে চার হাজার ৪০৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মারাত্মক অস্ত্রসহ এক হাজার ৩৪২টি অস্ত্র এখনো উদ্ধারের বাইরে। সাধারণ অস্ত্র নিয়ে তেমন চিন্তা না থাকলেও মারাত্মক অস্ত্রগুলো নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনই গণভবন, সংসদ ভবনসহ চারটি স্থাপনায় নিরাপত্তায় থাকা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) ৩২টি অস্ত্র লুট হয়। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ও এলএমজি। এসব অস্ত্র সাধারণ অস্ত্র নয়। এগুলো প্রশিক্ষিত লোক ছাড়া কেউ চালাতে পারে না। এর পরও এসব অস্ত্র ফেরত না দেওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। এই অস্ত্রগুলো কাদের কাছে রয়েছে, চিহ্নিত করে উদ্ধার করতে গিয়ে কূল-কিনারা পাচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
এসব অস্ত্র প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিতই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধারও হচ্ছে। তবে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রগুলো এখনো কোথাও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অস্ত্রগুলো উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।’
অন্যদিকে গোয়েন্দা তথ্য বলছে, নির্বাচনের আগে পাশের দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করছে। অস্ত্র যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবিকে সীমান্তে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। বিজিবি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ রোধে বিজিবি সদর দপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরে বিজিবি সদর দপ্তর থেকে দেশের সব সীমান্তের কর্মকর্তাদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার বিজিবি ৫৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ রোধে আমরা সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। সেই অনুযায়ী সীমান্তে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সীমান্তে রাতদিন আমরা দায়িত্ব পালন করছি। রাতে নাইটভিশন গগলস ব্যবহার করা হচ্ছে। বাইনোকুলার দিয়েও সীমান্তে পাহারা দেওয়া হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, কড়া নজরদারির পরও সীমান্তের ফাঁক গলে দেশে প্রবেশ করছে অবৈধ অস্ত্র। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লা, কক্সবাজার সীমান্ত বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি অঞ্চল আর সাগরপথ দিয়েও অস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে। এসব সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে ছোট ছোট অস্ত্র আনা হচ্ছে।
শুধু গত অক্টোবর মাসেই বিজিবি চারটি পিস্তল, একটি রিভলভার, তিনটি মর্টার শেল, ছয়টি হ্যান্ড গ্রেনেড, তিনটি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক, দুটি ডেটোনেটর এবং সাতটি অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করেছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার মতে, মোট চোরাচালানের ৪০ শতাংশ ধরা সম্ভব হয়, ৬০ শতাংশ ধরা সম্ভব হয় না। ফলে উদ্ধারের চিত্র থেকে কী পরিমাণ অস্ত্র দেশের ভেতরে প্রবেশ করছে, তার একটি চিত্র পাওয়া যায়।
তবে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবের অভিযানে গত কয়েক দিনে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৬ অক্টোবর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রেলওয়ে স্টেশনে আটটি বিদেশি পিস্তল ও বিস্ফোরক জব্দ করে সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় চারজনকে আটক করা হয়। গত ৩০ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রামের রাউজানে অভিযান চালিয়ে এক রাজনৈতিক নেতার বাড়ি থেকে ১০টি বন্দুক, একটি এয়ারগান, ১৫টি কিরিচ, চারটি রামদা, ১১টি কার্তুজ, চারটি কার্তুজের খোসা, তিনটি চায়নিজ কুড়াল, আটটি লাঠি ও ১৮টি আতশবাজি, মাদকসহ দুজনকে আটক করে র্যাব। একই দিন রাতে ঢাকার আশুলিয়ার গাজীরচটের মাটির মসজিদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ৩৩ রাউন্ড শটগান ও পিস্তলের কার্তুজ, চারটি দেশীয় অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি র্যাব সদস্যরা নরসিংদীর রায়পুরায় অভিযান চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেন।
অস্ত্রের যত ব্যবহার : গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সরোয়ার হোসেন বাবলা নামের এক সন্ত্রাসীকে। ওই সময় আহত হন চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ। গত ১১ নভেম্বর পুরান ঢাকায় তারেক সাইদ মামুনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দুই হত্যাকারীর হাতে রয়েছে পিস্তল। গত শুক্রবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় আবদুল মান্নান (৪০) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতা আবুল কালাম জহিরকে (৫০) গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ‘সন্ত্রাসী’ ছোট কাউছার ওরফে পিচ্চি কাউছারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে পরিবার।