হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসের সুরক্ষিত ভল্টের তালা ভেঙে অস্ত্র-গুলি চুরির ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে ২৮ অক্টোবর সকাল সোয়া ৭টার মধ্যে ভল্টে থাকা অস্ত্র-গুলি চুরির ঘটনা ঘটে। এই সময়ে কার্গো হাউসের নিরাপত্তায় বিভিন্ন সংস্থার মোট ১৭ জন দায়িত্ব পালন করছিলেন। যে কারণে তাঁদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। পুলিশসহ একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। এরই মধ্যে বিমান কর্তৃপক্ষ কার্গো হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চারজনের কাছে কৈফিয়ত তলব করে চিঠি দিয়েছে।
গত ১৮ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো হাউসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানে থাকা ভল্ট ভেঙে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৩৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ লাখ গুলি চুরি হয়। স্ট্রং ভল্টে থাকা ২০৮ নম্বর কার্টনে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ২১টি বক্সের সাতটির হদিস নেই। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় তিনটি জিডি করা হয়েছে। তবে বিমান মন্ত্রণালয় তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে মাত্র সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র চুরির হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে; চুরি প্রতিরোধে একগুচ্ছ সুপারিশও দিয়েছে।
পুলিশের তদন্তকারীরা বলেছেন, এই ১৭ জনের কেউ চুরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে পারেন, অথবা তাঁদের চরম গাফিলতির কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। এই রহস্য বের করতে তাঁদের ব্যক্তিগত সেলফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) যাচাই করা হচ্ছে। ২৭ অক্টোবর সকাল থেকে ২৮ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁরা কাকে কাকে ফোন করেছেন, কোন কোন ফোন নাম্বার থেকে তাঁদের ফোনে কল এসেছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখছেন পুলিশের তদন্তকারীরা। যে সময়ে চুরির কথা বলা হচ্ছে, ওই সময়ে কার্গো হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিমান, আর্মড পুলিশ ও আনসার সদস্যরা ডিউটি রেজিস্টারে ‘সব ঠিক আছে’ লিখে একজন আরেকজনের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। রেজিস্টারে তাঁরা সবকিছু ঠিক আছে লিখলেও ভল্টের তালা ভাঙা ছিল, ভেতরে অস্ত্র-গুলি ছিল না। তাঁরা কেন ডিউটি রেজিস্টারে এ কথা লিখলেন- এটাই একাধিক সংস্থার তদন্তকারীদের কাছে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। ওই ডিউটি রেজিস্টার ‘আমাদের সময়’-এর এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ের দুই শিফটে কার্গো হাউসের বাইরের প্রধান গেটে দায়িত্বে ছিলেন বিমান সিকিউরিটির তাজিম খান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। বিকাল ৪টা থেকে ভোর ৬টা ৪ মিনিট পর্যন্ত তাঁরা দফায় দফায় ভল্ট পরিদর্শন করেন বলে রেজিস্টারে উল্লেখ করেছেন। ভোরে দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় দায়িত্ব পালনকারী বিমানকর্মী লিখেছেন- ‘সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় বুঝিয়ে দিয়ে আমার কর্মস্থল ত্যাগ করিলাম।’ পরবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী রফিকুল ইসলাম সকাল ৭টায় দায়িত্ব গ্রহণের নোট দেন। তিনি ২৮ অক্টোবর লেখেন- ‘আমি নিরাপত্তারক্ষী রফিকুল ইসলাম ৭ ঘটিকায় কর্মস্থলে উপস্থিত হই, যাহা ডিএসও মুখলেছুর রহমান অবগত আছেন।’
এদিকে বিমানের ডিউটি রেজিস্টার ঘেঁটে দেখা যায়, ২৭ অক্টোবর বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন আটজন নিরাপত্তাকর্মী। তাঁদের মধ্যে বিমানকর্মী তিনজন, পুলিশ তিনজন ও দুইজন আনসার সদস্য রয়েছেন। অন্যদিকে রাত ১০টার পরে দায়িত্ব পালন করেন ৯ জন- তাঁদের মধ্যে বিমানের তিনজন, পুলিশের তিনজন ও আনসারের তিনজন সদস্য। অবশ্য ডিউটি রেজিস্টারে তারিখের ঘরে লেখা রয়েছে ২৮ তারিখ।
বিমান কর্তৃপক্ষের করা জিডিতে উল্লেখ আছে, সকাল ৭টা ৭ মিনিটে স্ট্রং রুমের তালা খোলার তথ্য পান এজিএম জামাল হোসেন। জামাল হোসেন নিজেও আগের রাত পৌনে ১০টায় ভল্ট ‘ঠিক’ আছে বলে রেজিস্টারে স্বাক্ষর করেন। প্রশ্ন উঠছে- রেজিস্টারে যখন সব ঠিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তখন ভল্টের তালা ভাঙল কখন? নিরাপত্তাকর্মীরা কী মিলেমিশে তথ্য গোপন করেছেন? নাকি আদৌ ভল্ট পরিদর্শন না করে শুধু কাগজে-কলমে দায়িত্ব পালন করেছেন- এসব প্রশ্নের উত্তর এখন জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জিএম বোশরা ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, চুরির সময় যাঁরা দায়িত্বরত ছিলেন তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশের জবাব ও তদন্তের ভিত্তিতে কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে এ ঘটনার পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মামলা করেনি। এ কারণে তদন্ত শুরু করতে দেরি হওয়ায় পুলিশের ওপর চাপও কমে গেছে। এমনকি চুরি হওয়া পণ্যের পূর্ণ তালিকাও এখনও প্রস্তুত করতে পারেনি বিমান কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে একাধিক সংস্থা ছায়া তদন্ত শুরু করলেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।
স্ট্রং ভল্টে মজুদ রাখা অস্ত্র-গোলাবারুদের একটি বড় অংশের মালিকানা ছিল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গান ম্যাক্স লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ফয়সাল কবির জানিয়েছেন, বিমানবন্দরের কার্গোতে আগুন লাগার প্রায় এক মাস পার হলেও তিনি তাঁর পণ্যের অবস্থান সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য পাননি। বিমানের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য না মেলায় তিনি মামলাও করতে পারছেন না বলে জানান। তাঁর করা জিডির তদন্তেরও অগ্রগতি নেই। ফয়সাল কবির বলেন, আমাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভল্টে ছিল। আজ পর্যন্ত জানি না সেগুলোর অবস্থা কী। বিমান কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক কিছু জানাচ্ছে না। ফলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপও নিতে পারছি না।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দুবর্ৃৃত্ত চক্রের হাতে চলে গেলে তা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
ঘটনার পর বিমান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়িয়ে চলার অভিযোগ উঠছে। নিরাপত্তায় ব্যর্থতা ও রেজিস্টারে মিথ্যা তথ্য লিপিবদ্ধ করা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তাকর্মীরা এখনও কর্মরত আছেন। পাশাপাশি বিমান কার্গো ও নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা এখন দায়িত্ব অন্য সংস্থার ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। এর প্রমাণ মিলেছে বিমান সচিব বরাবর পাঠানো একটি চিঠিতে, যেখানে ঘটনাটির দায় বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
তদন্তকারীরা বলেছেন, রেজিস্টারে মিথ্যা তথ্য, ভল্ট পরিদর্শন না করা, দেরিতে জিডি এবং আরও দেরিতে মামলা না করা- এসব কারণে পুরো তদন্তই জটিল হয়ে পড়েছে। এ কারণে চুরির সময়, জড়িত ব্যক্তিদের ভূমিকা, এমনকি চুরি হওয়া পণ্যের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমানবন্দরের মতো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরপর এমন ঘটনা ও ব্যবস্থাপনায় ঢিলেমি পরিস্থিতিকে সন্দেহজনক করে তুলছে।