ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দিনাজপুরের ছয়টি আসনে আগাম প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রতিদিনই গণসংযোগ করে ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে দুটিতে প্রার্থী নিয়ে দলের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সদরে মনোনয়ন নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করায় তাঁরা এককাট্টা হয়েছেন। অন্যদিকে অনেক আগে থেকে মাঠে রয়েছে জামায়াত।
স্থানীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বললেও দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। যদিও ৫ আগস্টের পর তাদের তেমন কার্যক্রম দেখা যায়নি। জোট নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এককভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। বাম দলগুলোর মধ্যে চারটি আসনে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। ছয়টি আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদ।
সদরে মনোনয়ন নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করায় তাঁরা এককাট্টা হয়েছেন। অন্যদিকে অনেক আগে থেকে মাঠে রয়েছে জামায়াত।
দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল)
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া আসনটিতে কখনো জেতেনি বিএনপি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছিল জামায়াত। এবার কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনজুরুল ইসলামকে মনোনয়ন দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের মজলিশে শুরা সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের দিনাজপুর শহর শাখার সাবেক সভাপতি মতিউর রহমানকে প্রার্থী করেছে জামায়াত।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আগে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। এবার তাঁরা বিএনপিকে ভোট দিতে চান।’ অন্যদিকে মতিউর রহমান বলেন, এ আসনে সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটার আছেন প্রায় দেড় লাখ। আশা করছেন, এবার ভোটাররা জামায়াতের ওপর আস্থা রাখবেন।
আসনটিতে ইসলামী আন্দোলনের চান মিঞা, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মোশাররফ হোসাইন, জেলা বাসদের সদস্য আবদুল্লাহ আল মুনীর, গণ অধিকার পরিষদের রিজওয়ানুল ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান, এনসিপির জেলা কমিটির সদস্য জেমিয়ন রয় ও আবু বক্কর দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ)
জেলা বিএনপির সদস্য সাদিক রিয়াজ চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আরও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাহারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ও শিক্ষা সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে তাঁদের অনুসারীরা কাফনের কাপড় পরে কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ করছেন।
সাদিক রিয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘এই আসনে আমার কয়েকজন সহযোদ্ধাও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। দল আমাকে মনোনয়ন দেওয়ায় অন্যরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।’
আসনটিতে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হচ্ছেন জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য এ কে এম আফজালুল আনাম। তিনি বলেন, ‘সব দিক বিবেচনা করে ভোটাররা আমাকে কথা দিচ্ছেন।’
এনসিপির জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী একরামুল হক ও ঈসমাইল হোসেন, ইসলামী আন্দোলনের জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক রেদওয়ানুল কারীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলার সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের সাঈদ, গণ অধিকার পরিষদের জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম আজম তৎপরতা চালাচ্ছেন।
এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন অর্ধডজন নেতা। বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তাঁরা আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু ৩ নভেম্বর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করায় সবাই এককাট্টা হয়েছেন। গত শুক্রবার নেতা-কর্মীরা আনুষ্ঠানিক প্রচারণাও শুরু করেছেন।
দিনাজপুর-৩ (সদর)
এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন অর্ধডজন নেতা। বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তাঁরা আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু ৩ নভেম্বর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করায় সবাই এককাট্টা হয়েছেন। গত শুক্রবার নেতা-কর্মীরা আনুষ্ঠানিক প্রচারণাও শুরু করেছেন। খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস হওয়ায় আসনটি ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ টানা তিনবার জয় পেয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বোন খুরশীদ জাহান হক।
জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন বলেন, চেয়ারপারসনের প্রার্থিতার খবরে দিনাজপুরবাসী উচ্ছ্বসিত। তাঁর মর্যাদার লড়াইয়ে নেতা-কর্মীরাও ঐক্যবদ্ধ। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকটি দল প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
আসনটিতে কয়েক মাস ধরে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন জামায়াতের মাঈনুল আলম। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন শুধু দিনাজপুরের নয়, গোটা জাতির সম্পদ। তবে শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনা করে আসনটি অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে পারতেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে মাঠে নেমেছেন।
এনসিপির অঙ্গসংগঠন যুবশক্তির কেন্দ্রীয় সংগঠক আরিফ মুন ৫ আগস্টের পর থেকে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জেলার সাধারণ সম্পাদক মুফতি খায়রুজ্জামান, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেজাউল করিম ও বাসদের জেলার আহ্বায়ক কিবরিয়া হোসেন তৎপরতা চালাচ্ছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন শুধু দিনাজপুরের নয়, গোটা জাতির সম্পদ। তবে শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনা করে আসনটি অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে পারতেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে মাঠে নেমেছেন।
দিনাজপুর-৪ (খানসামা-চিরিরবন্দর)
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আক্তারুজ্জামান মিয়াকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। বিগত দেড় দশক নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। খানসামা উপজেলা বিএনপির নেতা মোস্তাফিজুর রহমানও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আশা করি দল ও প্রতীক উভয় দিক থেকেই এগিয়ে থাকব।’
আসনটিতে কখনো জয় পায়নি জামায়াত। এখানে জেলার সাবেক আমির আফতাব উদ্দিন মোল্লা তৃতীয়বারের নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। দুবার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আনোয়ার হোসেন নদভী, খেলাফত মজলিসের ফয়জুল্লাহ বুলবুল, এনসিপির সোহেল সাজ্জাত ও গণ অধিকার পরিষদের ইমরান খান নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।
বিএনপি যখন প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে ব্যস্ত, তখন প্রচারে ব্যস্ত জামায়াতের প্রার্থী জেলা কর্মপরিষদের সদস্য আনোয়ার হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘এলাকায় দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভোটারদের মুখে এক কথা, এত দিন অন্যদের দেখেছি, এবার আপনাদের পক্ষে রায় দিতে চাই।’
দিনাজপুর-৫ (ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর)
এই আসনে গত আটটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটি এবার ভোটে অংশ নিতে পারবে না। এই আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় এখনো প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি দলটি। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ জেড এম রেজওয়ানুল হক এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সহসভাপতি কামরুজ্জামানের বিষয়টি আলোচনায় আছে। ইতিমধ্যে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা খুরশিদ আলমের নাম আলোচনায় আছে। তিনি বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন মাঠে কাজ করতে বলেছেন। ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনীতি করছেন। দল নিশ্চয়ই বিবেচনা করবে। এরপরও যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষ কাজ করবেন।
বিএনপি যখন প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে ব্যস্ত, তখন প্রচারে ব্যস্ত জামায়াতের প্রার্থী জেলা কর্মপরিষদের সদস্য আনোয়ার হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘এলাকায় দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভোটারদের মুখে এক কথা, এত দিন অন্যদের দেখেছি, এবার আপনাদের পক্ষে রায় দিতে চাই।’
আসনটিতে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক চিকিৎসক আবদুল আহাদ ৫ আগস্টের পর উঠান বৈঠক, গণসংযোগসহ বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের শাহ মো. আবু সায়েম, বাসদ নেতা আবুল কালাম, গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহাজাহান চৌধুরী নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।
দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-ঘোড়াঘাট-হাকিমপুর)
৯ মাসের বেশি সময় ধরে আসনটিতে প্রচারণা চালাচ্ছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এখানে জয় পেয়েছিল জামায়াত। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে আছি। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন এখানে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন। হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে তিনি সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠকসহ এলাকায় নানা কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে জামায়াত দুবার জিতেছে ঠিকই। কিন্তু একবার বিএনপি প্রার্থী দেয়নি, আরেকবার জোটের প্রার্থী ছিল। এলাকায় বিএনপির প্রতি মানুষের যে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস দেখেছি, তাতে আমরা চিন্তিত নই।’
এ ছাড়া এবি পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক, বাসদ নেতা আবদুল হাকিম, ইসলামী আন্দোলনের দিনাজপুর (দক্ষিণ) শাখার সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিক, খেলাফত মজলিসের মুফতি নুরুল কবির, গণ অধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সহসভাপতি বুলবুল আহমেদ, এনসিপির জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।