সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আস্থাভাজন এমন কয়েকজনকে ডিসি করা হয়েছে—প্রশাসনে যাঁরা দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের কেউ কেউ আওয়ামীপন্থী বা এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনে পর্যাপ্ত কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকা কর্মকর্তাদেরও ডিসি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের ৫০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগসংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে প্রশাসনে নতুন করে বিতর্ক জোরালো হয়েছে। নতুন ডিসি নিয়োগে সিনিয়রিটি, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশ অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং এসএসবির সভাপতি মন্ত্রিপরিষদসচিব এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের পছন্দই মুখ্য ছিল।
সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর দুটি প্রজ্ঞাপনে ২৩ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন জেলায় ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়। এসব কর্মকর্তার ছাত্রজীবনের বন্ধু ও চাকরিজীবনের ব্যাচমেটদের সঙ্গে আলাপ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
পাবনার ডিসি হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহেদ মোস্তফা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত সরকারের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন কর্মকর্তাদেরই হোস্ট অফিসার করা হয়, যাতে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে ভুল বা ক্ষতিকর বার্তা না যায়।
নারায়ণগঞ্জে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিসিএস ২৯তম ব্যাচের রায়হান কবিরকে। তিনি বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার থেকে এসেছেন।
এ ছাড়া জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার বিসিএস ২৫তম ব্যাচের একজন দক্ষ কর্মকর্তা। নির্বাচনকালীন ডিসিই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং এসপিসহ অন্যান্য সরকারি দপ্তর প্রধানদের সমন্বয়ের কাজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপির চেয়ে চার ব্যাচ জুনিয়র ডিসি কিভাবে সমন্বয় করবেন?
কুড়িগ্রামের ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন ছাত্রলীগের রাজনীতি করা ও ইসকন সদস্য উপভূমি সংস্কার কমিশনার অন্নপূর্ণা দেবনাথ। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কাজ করেছেন। তাঁর ডিসি পদে নিয়োগ পাওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অভিনন্দন জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু মহাজোট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহাজোটের একজন লিখেছেন, ‘অভিনন্দন ও শুভ কামলা রইল দিদিভাই।’
বিসিএস ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ এনামুল আহসানকে রংপুরের ডিসি করা হয়েছে। এর আগে তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ইউএনও ছিলেন বলে জানা গেছে। এ সময় এইচ টি ইমামের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। এই কর্মকর্তা বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রী সাবেক তথ্য সচিব কামরুন নাহারের পিএস ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের পিএসের সঙ্গে একাট্টা হয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের ভয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা তটস্থ থাকতেন। সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সঙ্গে তাঁর এখনো গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। গত ৫ আগস্টের পর এই কর্মকর্তা গা বাঁচিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পোস্টিং নেন। এসব এখন প্রশাসনে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যশোরে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ আশেক হাসান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি ফরিদপুরের জোনাল সেটলমেন্ট অফিসার হিসেবে আড়ালে চলে যান, কারণ তিনি আওয়ামী সুবিধাপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা।
মুন্সীগঞ্জের ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব সৈয়দা নূর মহল আশরাফী। প্রয়াত আওয়ামী নেতা এইচ টি ইমামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। এ কারণে সব সময় তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দায়িত্ব পালনে দেখা গেছে। গাজীপুরে দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার একজন এডিসির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। এ ছাড়া বরগুনার ডিসি করা হয়েছে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের উপসচিব তাছলিমা আক্তারকে। একসময় ছাত্রলীগ করা এই কর্মকর্তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম জনতা ব্যাংকের আওয়ামীপন্থী সিবিএ নেতা।
এইচ টি ইমামের আরেক ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা নাজমা আশরাফিকে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রাঙামাটিতে। আওয়ামী আমলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিশ্বস্ত ছিলেন বলে প্রশাসনে জোরালো গুঞ্জন রয়েছে।
নেত্রকোনার ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন সাইফুর রহমান। বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তা সাইফুর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাঠ প্রশাসনে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
ছাত্রলীগের রাজনীতি করা এস এম মেহেদী হাসানকে লক্ষ্মীপুরের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রেজাউল করিমকে ঢাকার ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিল করতেন বলে জানা গেছে।
‘গাছখেকো’খ্যাত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাসউদকে ঝিনাইদহের ডিসি করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিশোরগঞ্জে থাকাকালে সরকারি গাছ কাটার বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি ‘গাছখেকো মাসউদ’ নামে পরিচিতি পান। আওয়ামী লীগ আমলে মাসউদ তৎকালীন আইনমন্ত্রীর দাপট দেখিয়ে চলেছেন। প্রমাণিত অভিযোগ থাকার পরও মাসউদ এসি ল্যান্ড থেকে ইউএনও হন। ইউএনও থেকে এডিসি হন। সবই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তদবিরে।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের নির্বাচন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যবারের নির্বাচনের মতো নয়। ডিসি নিয়োগে সরকারের কিছু অনভিজ্ঞতা ও ভুলত্রুটি আছে। তবে তারা পরিস্থিতির শিকারও বটে। যাঁরা মাঠে অনভিজ্ঞ এবং দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাঁদের ডিসি পদে পাঠানো ঠিক হয়নি। ডিসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। এতে বিতর্ক বাড়বে। অনাস্থা তৈরি হবে।