তীব্র যানজট, বেদখল ফুটপাত, পার্ক, মাঠ আর দখলে-আবর্জনায় দুর্দশাগ্রস্ত জলাশয়ের শহর ঢাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক হিসেবে শপথ নেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। দায়িত্ব নেয়ার পর ‘ন্যায্য ঢাকা’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন রাজধানীর নগরশাসন হয়তো নতুন ধরনের চিন্তার দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে ‘মেটামডার্ন মিউনিসিপ্যালিজমের’ সূচনা হিসেবেও দেখেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক ব্যাপক। নাগরিক ভোগান্তি, অবকাঠামোগত বিশৃঙ্খলা আগের মতোই চলছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান উন্নতি নেই। ফুটপাত-ফুটওভার ব্রিজ নির্বিঘ্ন চলাচলের উপযোগী হয়নি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহাম্মদ এজাজ দীর্ঘ সময় খাল-জলাশয় ও নদী নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। এসব বিষয়ে সরকারের পলিসি লেভেলে কী ধরনের ত্রুটি হয়ে থাকে তা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। প্রশাসক হওয়ার পর গত নয় মাসে তার কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তারা বলছেন, এখনো ঢাকার নগর জীবনে ন্যায্যতা তো দূরের কথা ন্যূনতম পরিবর্তনটুকুও আসেনি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর মোহাম্মদ এজাজের প্রতিশ্রুতিগুলো কাগজে-কলমে আধুনিক শহর গড়ার বহুল আলোচিত তত্ত্ব ‘মেটামডার্ন নগরায়ণের’ সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে মিলে যায়। এ তত্ত্বে সম্পদের সমান বণ্টন, গণপরিবহনে ন্যায্য প্রবেশাধিকার, প্রকৃতি ও জনপরিসরকে জনসাধারণের সম্পদ হিসেবে রক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত এ মিল কেবল নীতিগত স্তরেই সীমাবদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্য নগরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নগর পিতার আসনে বসা এজাজের রিপোর্ট কার্ড এখনো শূন্য। তার প্রতিশ্রুতিগুলো তত্ত্বে মেটামডার্ন হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়নি।
আধুনিক আমলাতান্ত্রিক নগর ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জনবান্ধব নগরী গড়ে তোলার অন্যতম চর্চিত তত্ত্ব মেটামডার্ন মিউনিসিপ্যালিজম। এর মূল ধারণা হলো শহরের উন্নয়ন বা পরিষেবা শুধু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সিদ্ধান্তে নয়; বরং সংগঠিত নাগরিক অভিজ্ঞতা ও মতামত, নাগরিক সম্মেলন, জনসাধারণের সম্পদ (পার্ক, খাল, মাঠ, পথঘাট) রক্ষার সম্মিলিত নীতির ওপর দাঁড়াবে। আধুনিক আমলাতন্ত্রের ওপর থেকে নিচে নির্দেশ দেয়ার বদলে নগরায়ণের মেটামডার্ন তত্ত্ব নিচ থেকে ওপরের দিকে নীতি তৈরির পথ খুলে দেয়। যেখানে শহরের জটিল সমস্যা যেমন জলাবদ্ধতা, চলাচল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পার্ক-মাঠের প্রবেশাধিকার কিংবা পরিবেশগত ঝুঁকি—সবকিছুই নাগরিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাধান করা হয়। কিন্তু ডিএনসিসির নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত এমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলেনি। রাজধানীবাসী দীর্ঘদিন ধরে যে ধরনের অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত পরিষেবার ভোগান্তিতে ছিল তা অব্যাহত আছে।
ডিএনসিসির বিভিন্ন স্থানে চলমান খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ এখনো নিরসন হয়নি। রাজধানীবাসীর অভিযোগ এ ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি যেন ঢাকার স্থায়ী ‘উন্নয়ন সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে, যেখানে কাজের চেয়ে ভোগান্তিই বেশি স্থায়ী থাকে। ঢাকা শহরের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মিরপুর এলাকা বর্তমানে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে ডিএনসিসির চলমান ইমপ্রুভমেন্ট অব ডিফারেন্ট ড্যামেজড রোড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড সার্ভিস প্যাসেজ ডেভেলপমেন্ট (আইডিআরআইএসপি) প্রকল্প। মিরপুর ১০ নম্বরসংলগ্ন বাউন্ডারি রোড, ফলপট্টি, কবরস্থান রোড ও সমাজকল্যাণ রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত সংস্কারের কাজে চলছে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণসামগ্রীর স্তূপায়ন। ফলে এ এলাকা এখন ধুলাবালি ও জলাবদ্ধতায় চরম বিপর্যয়ের মুখে।
এ খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এলাকার প্রধান ভোগান্তি যানজট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকীর্ণ সড়কগুলো এমনিতেই হকার ও দোকানপাটের ফুটপাত দখলের কারণে সংকুচিত। এর সঙ্গে মেট্রোরেল স্টেশনসংলগ্ন এলাকাগুলোয় যাত্রী ওঠানামার ভিড় এবং অবৈধ পার্কিংয়ের সমস্যা যোগ হয়ে পিক আওয়ারে জট এখন অসহনীয় পর্যায়ে। অর্থাৎ উন্নয়নের কাজই বর্তমানে নাগরিকদের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দায়িত্ব নেয়ার পর জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন মোহাম্মদ এজাজ। তবে বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। অপরিকল্পিত ও পুরনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং পলিথিন ও গৃহস্থালি বর্জ্য দ্বারা ড্রেন ও খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই কাজীপাড়া থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় হাঁটু বা কোমরপানি জমে যায়।
জনসংখ্যার তুলনায় নাগরিক পরিষেবার নিম্নমান অন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ অলিগলির রাস্তাগুলো প্রায়ই খানাখন্দে ভরা থাকে। পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে; অপর্যাপ্ত ডাস্টবিন ও খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলার কারণে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আর রাতের বেলা রাস্তার আলোর অভাবে এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় চুরি-ছিনতাইয়ের মতো সামাজিক অপরাধের কারণে নাগরিক নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে।
ন্যায্য নগর ইশতেহারের অন্যতম শর্ত হলো নগরীর সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সমান সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান প্রশাসক অভিজাত শ্রেণীর জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একজন নগর পিতার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এটা সত্যি। নগরীর সবকিছু ঠিক করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ বিষয়গুলো বাদ দিলেও এমন কিছু মৌলিক কাজ আছে যেগুলো চাইলেই বর্তমান প্রশাসক বা যেকোনো মেয়রের পক্ষে করা সম্ভব। বিশেষ করে যেসব পার্ক-মাঠ বেদখল আছে, সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করা। কিন্তু আমরা দেখছি, শহীদ তাজউদ্দীন পার্কসহ বিভিন্ন পার্ক আগের মতোই অভিজাতদের লিজ দেয়া হচ্ছে। সে মাঠগুলোতে সোসাইটির মানুষ ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না। পার্কগুলো এখনো সবার জন্য উন্মুক্ত হয়নি। তাহলে ন্যায্য নগর গড়ার এ সহজ জায়গাতেই তো তিনি ব্যর্থ হলেন। আসলে তিনি মানুষের জায়গায় দাঁড়িয়ে যেসব দাবি করতেন, এখন প্রশাসক হওয়ার পর তার থেকে সে বিষয়গুলো আমরা বুঝে পাচ্ছি না। এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।’
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঠ–পার্ক উন্মুক্তকরণ হলে সবচেয়ে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যেত, কারণ এটি নাগরিক সুস্বাস্থ্য, সামাজিক মেলামেশা ও নিরাপদ জনপরিসর তৈরির মৌলিক শর্ত। কিন্তু মাঠ ও পার্ক দখলমুক্ত করা ডিএনসিসির ন্যায্য নগর প্রতিশ্রুতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেও বাস্তবে এ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
প্রশাসক এজাজ মাঠ ও পার্ক দখলকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শহীদ তাজউদ্দিন মাঠে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের দখল রক্ষা করার জন্য আল মাহমুদের নামে লাইব্রেরি নির্মাণ হয়। সে লাইব্রেরি উদ্বোধন করেন মেয়র। লাইব্রেরি খুব ভালো কাজ। এজন্য অনেক জায়গা আছে। তাই বলে মাঠ দখল করে সেখানে লাইব্রেরি বানাতে হবে? মাঠে থাকা ক্লাব ভেঙে না দিয়ে সেটাকে বৈধতা দেয়ার জন্য বানানো হয়েছে লাইব্রেরি। আমরা দেখেছি, এখনো নগরীর অনেক মাঠ-পার্ক বেদখল, নতুন করে দখল হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসক বা সরকার তো সেগুলো জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়নি। আমরা মনে করি, এটা এক ধরনের সিন্ডিকেট। প্রশাসক এজাজের পাশে যারা ঘোরেন, তিনি যাদের নিয়ে কাজ করেন, তারা সবাই এ সিন্ডিকেটেরই অংশ। আমরা দেখেছি, এ সিন্ডিকেটকে কাজ দেয়ার জন্য যেকোনো ধরনের অনিয়ম করতেও পিছপা হন না ডিএনসিসি প্রশাসক।’
প্রশাসক হওয়ার পরের মাসে এক ঘোষণায় মোহাম্মদ এজাজ বলেছিলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যদি ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করেন তাহলে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’ কয়েক মাসের মাথায় সিটি করপোরেশন নিজেই ফুটপাত দখলের উৎসবে নেমেছে। গুলশানের একটি ব্যস্ত সড়কে দৈনিক ৩৯৪ টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নতুন বাজারের একটি সড়ক দখল করে ওয়ার্ড নির্মাণের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও এ বিষগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ডিএনসিসি প্রশাসক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
ডিএনসিসির প্রশাসকের ন্যায্য নগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগর জীবন। এর মানে হলো জলবায়ু সহনশীল নগরীর পাশাপাশি প্রকৃতির প্রাণের অধিকার নিশ্চিত করা এবং নগরীর অবকাঠামোগুলো প্রকৃতিবান্ধব করা। কিন্তু ডিএনসিসিকে প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। প্রশাসক হওয়ার পর ঢাকার উন্মুক্ত সড়কে এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন মোহাম্মদ এজাজ। দিল্লিসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে এসব এয়ার পিউরিফায়ার প্রযুক্তি ব্যর্থ হয় অনেক আগেই। এসব ব্যর্থ প্রযুক্তি ঢাকায় স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে পরিবেশবিদদের তোপের মুখে পড়েন প্রশাসক। বিতর্কের মধ্যেই দাবি করেছিলেন, একটা এয়ার পিউরিফায়ার ১০০টি গাছের সমান উপকার দেবে। এতে পরিবেশকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। একপর্যায়ে এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।
ঢাকার নগর জীবনে এখনো প্রকৃতিবান্ধব অবকাঠামো কিংবা পরিকল্পনা গুরুত্ব পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম, এত জীবনদানের পরও ঢাকাকে এখনো প্রকৃতিকেন্দ্রিক নগর হিসেবে বিকশিত করা সম্ভব হয়নি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা ঢাকাকে শুধু মানুষের শহর হিসেবে ভাবছেন আর সেভাবেই এগিয়ে নিচ্ছেন। এখানে পাখি, গাছপালা কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় আবাস বা চলাচলের পরিবেশ নেই। গাছ, খাল, জলাধার চোখের সামনে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা এগুলো রক্ষায় যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছি না। নদী, খাল,–জলাধার দখল ও দূষণে ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে নগরের প্রাকৃতিক জীবনধারা।’
ডিএনসিসি প্রশাসক হওয়ার আগে মোহাম্মদ এজাজ খাল-জলাশয় নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন। তিনি গণমাধ্যমকে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বারবার বলেছেন, শুধু খাল পরিষ্কার করা টেকসই সমাধান নয়। এজন্য খালের সীমানা নির্ধারণ করার পাশাপাশি এমনভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করতে যেন খালগুলো আর নষ্ট করা না হয়। তবে নিজে প্রশাসক হওয়ার পর এখনো একটি খালও তিনি নিজের বলা মডেলে পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘খাল পরিষ্কার করা টেকসই নয় এ কথা এখনো বলি। এজন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা খালের সীমানা নির্ধারণের কাজও শেষ করেছি। এখন টেকসই কার্যক্রম শুরু করব।’ মেয়র আতিকের সময়ই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খালের সীমানা নির্ধারণ হয় এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘কাজগুলো আগে হয়েছে, আমি সমাপ্ত করে দিয়েছি।’
নদীকর্মী হিসেবে মোহাম্মদ এজাজের কাছে রাজধানীর খালগুলো কেন্দ্র করে ব্লু নেটওয়ার্ক গুরুত্ব পাওয়ার আশা করেছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। এ নিয়ে বারবার আলাপ করেও কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চমকপ্রদ কিছু শব্দ আর কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে ঢাকার মতো জটিল নগরীর পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমি প্রশাসক এজাজকে খালগুলো নিয়ে ব্লু নেটওয়ার্কের কথা বলেছি। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেননি। মেয়র আতিকের সময় জাতীয় গৃহায়নের জমি কালশী মাঠ রক্ষা করেছিলাম, আর মোহাম্মদ এজাজ আসার পর সে মাঠ হাতছাড়া হয়ে যায়। এ নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কীভাবে যেন জাতীয় গৃহায়ন নিয়ে গেছে। এই হলো আমাদের প্রশাসকদের অবস্থা।’
ঢাকার জনস্বাস্থ্য মারাত্মক রকম ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘যে হারে মানুষ ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে, যদি স্বাভাবিক সময় হতো তীব্র আন্দোলন দেখা যেত। কিন্তু এখন ডেঙ্গু নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে? আগের মেয়ররা লোক দেখানোর জন্য হোক আর যেভাবেই হোক ক্রাশ প্রোগ্রাম নিত, অনেক কিছু করত। এখন তো তাও দেখছি না।’
রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মশার প্রজননস্থল শনাক্তকরণ, লার্ভিসাইডিং বা জনসচেতনতার কার্যক্রম যথাযথ ও ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলেই নগরবাসীর অভিযোগ। ডেঙ্গু মোকাবেলায় ডিএনসিসি প্রশাসন ব্যর্থ পথেই হাঁটছে বলে মন্তব্য করেছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির মেয়র চাইলে ডেঙ্গু নির্মূলে আধুনিক অনেক পদ্ধতিই অনুসরণ করতে পারতেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, আগের ব্যর্থ পদ্ধতিতেই চলছে নগরবাসীর মশক ব্যবস্থাপনা। সেকেলে মশক ব্যবস্থাপনা দিয়ে ডেঙ্গু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
ঢাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে অনেক দিন ধরেই সরব পরিবেশকর্মী নয়ন সরকার। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার একজন বাসিন্দা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির নতুন প্রশাসক নিয়োগ পাওয়ার পর আশাবাদী হয়েছিলাম এটা ভেবে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিছু কাজ হলেও ব্যাপক হতাশ হয়েছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি আসেনি, ফুটপাতে নির্বিঘ্নে চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। বাস্তবে মাঠ ও পার্ক দখলমুক্ত হয়নি; বরং একাধিক দখলদারকে মাঠ ও পার্কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হয়নি। বায়ু ও শব্দদূষণ কিংবা নদী এবং খালের দূষণ কমেনি। যদিও এসবের জন্য দীর্ঘ সময় দরকার। এছাড়া ডিএনসিসি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও পুরোপুরি ব্যর্থ। একাধিক ফুটপাত-ফুটওভার ব্রিজ নির্বিঘ্নে চলাচল উপযোগী নয়। সড়কদ্বীপে বিলবোর্ডের আধিক্য বেড়েছে। গতানুগতিক ধারায় উন্নয়ন কার্যক্রমে গাছ কাটার উদাহরণও দেখেছি। যতটা আশাবাদী হয়েছিলাম আসলে এখন পর্যন্ত প্রত্যাশা কমই পূরণ হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এত বছর ঢাকার সব বরাদ্দ হতো অভিজাত এলাকাবাসীর জন্য। আমি এসে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দিয়েছি। আমরা ৩২টি নতুন মাঠ উদ্ধার করেছি। নারীদের আলাদা পিংক টয়লেট নির্মাণ করছি। হিজড়াদের ফুডকোর্ট দিচ্ছি। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছি। ঢাকার খাল-জলাশয় নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করে এখন কাজও শুরু করে দিয়েছি। আমরা ফুটপাত ও খাল দখলের বিরুদ্ধে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি।’