“বাস্তবে এটার কোনো মূল্য নাই। আইনগত কোনো ভিত্তি নাই। আগামী সংসদ যদি এগুলো না মানে, তাহলে কিছু করণীয় নাই।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন, তা ‘অপ্রয়োজনীয়, সংবিধানের বাইরের বিষয়’ বলে মনে করছে বাম ধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এমন মত প্রকাশ করেছে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করা দলগুলো।
এদিন দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে এক সঙ্গে আয়োজনের ঘোষণা দেন।
উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষরের পর এদিনই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা হয়, যেখানে গণভোট ও সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি কীভাবে এই আদেশ জারি করলেন, সেই প্রশ্ন তুলে বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই যে রাষ্ট্রপতি যে স্বাক্ষর করল, আদেশটা জারি করল, এটা কোন ক্ষমতা বলে? এই অধিকার তো তার নাই। সেটা তো সে করতে পারে না।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তো এই ধরনের কোনো আদেশ জারি করতে পারে না। অধ্যাদেশ জারি করতে পারে। এটাও তো বিদ্যমান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হল।”
একইভাবে গণভোট আয়োজন ‘সম্পূর্ণরূপে সংবিধান বহির্ভূত এবং অপ্রয়োজনীয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা এবং ঐকমত্য কমিশনের প্রধান একই ব্যক্তি। সেটা একটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট।
“এই গণভোট, পি আর, উচ্চকক্ষ এগুলোতে আমরা ওখানে (ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়) বিরোধিতা করেছি। বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ অপ্রয়োজনীয়। গরিবের দেশে এটা দরকার নাই। গরিবের ঘোড়া রোগের মত ব্যাপার হয়।”
ফিরোজ বলেন, “এই যে গণভোট, গণভোটটা আমরা বলছি অপ্রয়োজনীয়। এই গণভোটের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। আইনগত কোনো ভিত্তি থাকবে না। এটা হল জনগণের সম্মতি, একটা নেওয়া হল। কিন্তু এটা হল যে, এই গণভোটটাও জনগণের সম্মতি। আবার জাতীয় সংসদে যারা পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচন হবে, তারাও কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট পেল।
“এক জনগণের সম্মতি নিয়ে আরেকটা জনগণের সম্মতির উপরে তারা চাপিয়ে দিতে পারে না। বাস্তবে এটার কোনো মূল্য নাই। আইনগত কোনো ভিত্তি নাই। আগামী সংসদ যদি এগুলো না মানে, তাহলে কিছু করণীয় নাই। আমরা গণভোটটা অপ্রয়োজনীয় মনে করছিলাম আগেও, এখন আমরা মনে করি অপ্রয়োজনীয়।”
তিনি বলেন, “গণভোট, উচ্চকক্ষ এই সমস্ত বিধান, সাংবিধানিক আদেশ এগুলোর দিকে জনগণের এখন মনোযোগ নাই। জনগণের মনোযোগ এখন নির্বাচন কমিশনে। সবাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে? সুষ্ঠু হবে কিনা? নিরপেক্ষ হবে কিনা? সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দিকে মনোযোগ দেওয়াটা জরুরি।”
বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “এখানে নোট অফ ডিসেন্ট তো পুরোটাই অগ্রাহ্য করা হল। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলাপ আলোচনা হল, পুরোটাই তো অগ্রাহ্য করা হল। গণভোটে যে চারটে প্রশ্ন নির্ধারণ করা হল, যে প্রক্রিয়ায়, এটাতেও একটা ভোট, মানে এই চারটা প্রশ্নের উপর কিন্তু ভোট দিতে পারবেন।
“দেখা গেল চারটার মধ্যে তিনটা প্রশ্নে কেউ একমত। একটা প্রশ্নে তার ভিন্ন মত আছে। তো এই ভিন্নমতটা সে কীভাবে রাখবে? তখন সে হাঁ দিতে চাইলেও একটা প্রশ্নের জন্য দিল না। তো মানে এখানে ভিন্ন মত রাখার তো সুযোগ থাকল না।”
তিনি বলেন, “জনগণ যদি তার মতামত দিতে চায়, আমি যদি ধরি জনগণই সর্বোচ্চ মত প্রকাশ করতে পারে এবং সেটাই নির্ধারিত হবে। কিন্তু যদি একটা ব্যাপারে দ্বিমত থাকে, তখন দেখা যাবে যে সে চাইলেও সেখানে হাত দিতে পারবে না। তাকে ‘না’ দিতে হবে।
“আর ভিন্নমত রাখলে সংস্কার কার্যক্রম সেটাই পুরোটা ব্যাহত হবে। এটা একটা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হয় না।”
বিদ্যমান সংবিধানে গণভোটের সুযোগ না থাকায় এটা নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই মন্তব্য করে সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, “এখন আমরা বলব যে সামনে যে নির্বাচন আছে, সাধারণ নির্বাচন, সে নির্বাচনটা দ্রুত সমাপ্ত করেন। গণভোট সম্পর্কে তো আমরা আগেই বলছি, এটা সংবিধানে নাই। এর কোনো দরকার নাই। এটা নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই।”
সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স পুরো ঐকমত্য কমিশনের সবগুলো আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন গণভোট অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে গণভোট হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। উচ্চকক্ষ হবে গরিবের হাতি পোষা। অপ্রয়োজনীয়।”
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রিন্স বলেন, “কোন ৩০ প্রস্তাব? এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করবে কে? দেশবাসীকে জানানো হবে কীভাবে? সংবিধান সংস্কার পরিষদ কোথা থেকে এল? এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এখন অগ্রহণযোগ্য।
“লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য বিদেশকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা ও অবাধ, গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেন আগে।”
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কোনো বক্তব্য না থাকার বিষয়টিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন বাসদ মার্কর্সবাদীর মাসুদ রানা।
তিনি বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে নানান ঘটনা ঘটছে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। রাস্তায় মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে এ বিষয় নিয়ে সরকারের দিক থেকে উনি কোনো দিক নির্দেশনা দিলেন না। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো দিক নির্দেশনা এল না।এটাও উদ্বেগজনক।”
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে এক সঙ্গে আয়োজনের ঘোষণাসহ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে এখনই কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নূরুল আম্বিয়া।
তিনি বলেন, “আমরা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাব।”