ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগ মুহূর্তের প্রস্তুতিমূলক কাজ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগামী ১৩ নভেম্বর থেকে সংলাপ শুরুর প্রাথমিক তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা আছে। তফশিলের আগে সময় কম থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এবার পৃথক সংলাপ হবে না। প্রতিটি সংলাপে সমমনা দলগুলোর নেতাদের একসঙ্গে ডাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে এ সংলাপ সফলভাবে শেষ করাকে বড় ধরনের কাজ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এছড়া তফশিল ঘোষণার আগে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফের বৈঠকের কথা ভাবছে কমিশন। গণভোট বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা না পাওয়ায় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার লক্ষ্য রয়েছে ইসির। ১২ ফেব্রুয়ারি বা এর আগে যেকোনো দিন ভোট গ্রহণ হবে। এ লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি পূর্ণোদ্যমে চলছে। ডিসেম্বর মাসে তফশিল ঘোষণা হবে, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই এসব কাজ চলছে। দু-একটি বিষয় ছাড়া সবকিছুই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, চলতি মাসের মাঝামাঝি সংলাপ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংলাপই নির্বাচনি প্রস্তুতির শেষপর্ব। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আরপিও ফের সংশোধন হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে যেসব কাজ বাকি, নভেম্বরের মধ্যে তা শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’ সংশোধনীর গেজেট প্রকাশ হতে যাচ্ছে। বড় ধরনের সংশোধনীসহ খসড়া বিধিমালার এসআরও জারির জন্য গত বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ইসি। এছাড়া ‘নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা’র সংশোধনীর খসড়া চলতি সপ্তাহে চূড়ান্ত করতে যাচ্ছেন ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আচরণ বিধিমালা এবং পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল’ চূড়ান্ত করবে ইসি। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত খসড়া তৈরি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের আয়োজন চলছে। গণভোট বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা না পাওয়ায় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির মাঠপর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে আগামী ১৬ নভেম্বর ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছে ইসি। এর মাধ্যমে প্রবাসী এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। এজন্য ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নাম ও প্রয়োজনীয় তথ্য ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে (ইএমএস)’ এন্ট্রি করা হচ্ছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে এই অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। তারা আরো জানান, ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনার মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে ইসি থেকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা পাননি। তাদের নামও ইএমএস এ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যদিও বিএনপি তাদের নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত না করার দাবি জানিয়ে আসছে।
কর্মকর্তারা বলেন, ভোটার এলাকা স্থানান্তরের শেষ তারিখ ১০ নভেম্বর। এদিন পর্যন্ত যেসব আবেদন জমা হবে, সেগুলো নিষ্পত্তি করা হবে। এছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে দাবি ও আপত্তি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে আগামী ৩০ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারা বলেন, ইতোমধ্যে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজ শেষ।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে সংলাপ : কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, আইন সংশোধন ও নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি ইসি। গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ কাজগুলো শেষ করার কথা ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও পিছিয়ে গেছে। ১৩ নভেম্বর প্রথম দিনের সংলাপ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুই দফায় পাঁচটি করে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। সংলাপে জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত দলগুলো ডাকার পরিকল্পনা আছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকায় দলটিকে সংলাপে ডাকা হবে না। যদিও জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ফ্যাসিস্টের সহযোগী হিসাবে আখ্যায়িত করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তফশিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষ করতে হবে। তাই আমরা প্রতিবার কয়েকটি দল নিয়ে বৈঠকের পরিকল্পনা করছি। জাতীয় পার্টিকে সংলাপে ডাকা হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
আচরণবিধির গেজেট দু-একদিনে : ইসি সূত্র জানায়, দু-একদিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার গেজেট প্রকাশ হতে যাচ্ছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, বিগত নির্বাচনের তুলনায় এবার বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে আছে, নির্বাচনি প্রচারে পোস্টার এবং ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে বিলবোর্ডে প্রচার করা যাবে। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের সরকারি অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করায় তারা নির্বাচনি কোনো প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশে নির্বাচনি সভা-সমাবেশ বা কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারবে না। নির্বাচনি প্রচারও চালাতে পারবে না। এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। প্রার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা সদস্য হয়ে থাকলে, প্রচার শুরুর আগে পদত্যাগ করতে হবে। আচরণ বিধিমালা লংঘনে সাজা বাড়ানো হয়েছে। কারাদণ্ডের বিধান আগের মতো ছয় মাস থাকলেও অর্থদণ্ড ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় লাখ টাকা করা হয়েছে। বিধিমালা লংঘনে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আশা করছি সংলাপ শুরুর আগে আচরণ বিধিমালার এসআরও জারি হবে।
অন্যান্য প্রস্তুতি : জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ বিধিমালা চূড়ান্ত হতে পারে। এছাড়া নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম ও ১৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনও শেষ হবে চলতি মাসে। এছাড়া আগামী ১৬ নভেম্বর পোস্টাল অ্যাপ বিডি উদ্বোধন করা হবে। ওই অ্যাপ উদ্বোধনের আগেই প্রচার শুরু করেছে ইসি।
গণভোট আয়োজন : ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। কিন্তু গণভোট আয়োজনে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে। সরকারের গ্রিন সিগন্যাল পেলে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে রোজার আগে করতে হবে-সরকারের এমন সময়সীমা আমরা পেয়েছি। সে অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। গণভোটের বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা পাইনি।