অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবারও ঘিরে উঠেছে বিতর্ক। নানান কারণে সমালোচিত হওয়া সাবেক সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে অন্যত্র বদলি করা হলেও, বদলায়নি প্রশাসনের অন্দরের চিত্র। নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া পর প্রশাসনের গতি ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও মোখলেস সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হতে পারেনি জনপ্রশাসন। সাবেক সচিবের রেখে যাওয়া ‘সেই সিন্ডিকেট’ এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ (এপিডি)। এতে যেন সাবেক সচিব মোখলেস উর রহমানের সিন্ডিকেটের যাঁতাকলে এখনো প্রশাসন।
অভিযোগ রয়েছে, গত এক বছরে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে একটি বিশেষ দলের অনুগত কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার হলেও মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত-সর্বত্রই একটি বিশেষ দলীয় রঙ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একসময় জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা মোখলেসের আমলে যে প্রশাসনিক ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি হয়েছিল, সেটিই আজও অদৃশ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের ঘোর আপত্তি থাকায় নতুন এপিডি হিসেবে যে কর্মকর্তাকে পদায়ন করা কথা ছিলো তাকে পদায়ন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিবকেই এপিডি উইংয়ের দায়িত্ব নিজের কাছে রাখতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বদলি হয়ে আসা নতুন সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেও সেই পুরোনো মোখলেস কাঠামো ভাঙা সম্ভব হয়নি। আগের মতোই অঘোষিত সিন্ডিকেট দ্বারাই জনপ্রশাসনের এপিডি উইং পরিচালিত হচ্ছে। এতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এখন বড় প্রশ্ন। জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পুরনো সিন্ডিকেটের প্রভাব থাকলে সরকারি সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা আসবে না। যত দ্রুত সম্ভব এপিডি উইংসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে ১৫ দিনে প্রশাসন থেকে ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্থরে বদলি ও পদায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সে নির্দেশনাগুলো এখনো বাস্তবায়ন শুরু করতে পারেনি জনপ্রশাসন। একদিকে পুরোনো সিন্ডিকেট, অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সাবেক সচিবদের ভাষায়, যদি জনপ্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ পুরোনো সিন্ডিকেটের হাতেই থাকে, তবে নিরপেক্ষ সরকারের পুরো দর্শনই প্রশ্নবিদ্ধ। জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব থাকলে সরকারি সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা আসবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব এপিডি উইংসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিবর্তন আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে জনপ্রশাসন এখন গভীর নৈরাজ্যের মুখে পড়বে বলে মনে করছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত কর্মকর্তাদের চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করা, অবৈধ সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রশাসনের শীর্ষ (ইন সার্ভিসে) পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, মাঠ প্রশাসনে দলকানা, বিতর্কিত ডিসিদের প্রত্যাহার করে নিরপেক্ষ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ার দাবিতে আবারো সচিবালয়ে সক্রিয় হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক সচিব মো. আব্দুল খালেক এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আজ রোববার থেকে আমরা সচিবালয়ে সক্রিয় হচ্ছি। গত ২৯ অক্টোবর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি বাতিল করায় প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি। মনে করেছি এখন থেকে প্রশাসন ভালো কিছু হবে। কিন্তু গত ১০ দিনে কিছুই হয়নি। বরং জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগের পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আবারও ঘিরে উঠেছে বিতর্ক। সচিব বদল হলেও বদলায়নি প্রশাসনের অন্দরের চিত্র। এক সময়কার সচিব মোখলেস উর রহমানের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট এখনো মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, বর্তমানে এপিডি উইংয়ে দায়িত্বে থাকা একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশাসন ক্যাডারে মার্জ করিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন। এগুলো নিয়ে নতুন জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে কথা বলে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরবো।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আবারও ঘিরে উঠেছে বিতর্ক। সচিব বদল হলেও বদলায়নি প্রশাসনের অন্দরের চিত্র। বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ অন্তত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বে আছেন চুক্তিভিত্তিক সচিবরা। এমনকি পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সাত সদস্যের মধ্যে চারজনই চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তা। এতে প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক আমলাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে, ক্ষোভ বেড়েছে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে। এক সময়কার সচিব মোখলেস উর রহমানের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট এখনো পুরো মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করছে এমন অভিযোগ কর্মকর্তাদের। এর ফলে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে দলীয় রঙ আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? নির্দলীয় সরকারের অধীনে চললেও প্রশাসনের কেন্দ্রে এখনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রভাব বলয় দৃশ্যমান। সরকারের বহু সিদ্ধান্তেই প্রতিফলিত হচ্ছে পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনদের প্রভাব। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই ওই দলের অনুগত বলে পরিচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সচিব বলেন, মোখলেস সাহেব বিদায় নিলেও রেখে গেছেন এমন একটি নেটওয়ার্ক, যারা এখনো অফিসের ভেতর-বাইরে সব সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখেন।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তাকেও সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে রক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যে কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চান, তাদের পদায়ন করা হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায়। একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা সরকারি কর্মকর্তা, কিন্তু এখন মনে হয় রাজনৈতিক দলের মাঠকর্মী। বর্তমানে এপিডি উইংয়ে দায়িত্বে থাকা এক বিশেষায়িত ক্যাডারের প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশাসন ক্যাডারে মার্জ করিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র, কৃষি, স্থানীয় সরকার ও সড়ক পরিবহন এই চার মন্ত্রণালয়েই এখন তাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জনপ্রশাসনের এক সাবেক যুগ্মসচিব বলেন, এখন জনপ্রশাসন চালাচ্ছে এক প্রভাবশালী ক্যাডার-গোষ্ঠী।
নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ‘রাজনৈতিক ছাপ’ : বিগত সরকারের মতোই এখনো পদোন্নতিতে দেখা যাচ্ছে পক্ষপাতিত্ব। মোখলেস সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠরা গুরুত্বপূর্ণ পদে যাচ্ছেন, আর দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তারা পড়ছেন উপেক্ষিত অবস্থায়। এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) সভায়ও রাজনৈতিক তকমা বিবেচনা করেই ফাইল তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, যোগ্যতা নয়, সম্পর্কই এখন পদোন্নতির চাবিকাঠি। ২০তম ব্যাচের পদোন্নতি কেন আটকে রয়েছে? বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি না পেয়ে হতাশ। একাধিক সভা হলেও এসএসবি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারছে না। রাজনৈতিকভাবে অপছন্দনীয় কর্মকর্তাদের ফাইল বারবার ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এদিকে, দলীয় ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিত করতেই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২৪তম ব্যাচের বঞ্চনা : বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও যুগ্মসচিব পদোন্নতিতে বঞ্চিত। তারা এসএসবির সভাপতির কাছে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে আবেদন করলেও আট মাস পেরিয়ে গেছে, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, সেটাই এখন অপরাধ। এর মধ্যে ডিসি নিয়োগে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে। পরে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে গত ২১ সেপ্টেম্বর বদলি করে পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এর ২১ দিন পর জনপ্রশাসনের এই পদে বদলি করা হয় চুক্তিতে থাকা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহছানুল হককে।
নতুন সচিব, কিন্তু পুরোনো ছায়া : নতুন সচিব দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের গতি ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও সাবেক সচিবের রেখে যাওয়া ‘সিন্ডিকেট’ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ (এপিডি) উইং এখনো তারই আস্থাভাজনদের নিয়ন্ত্রণে। সরকার নির্দলীয় হলেও মাঠপর্যায়ে থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত- সর্বত্রই দলীয় রঙ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একসময় জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা মোখলেস উর রহমান এর সময় যে প্রশাসনিক ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি হয়েছিল, সেটিই আজও অদৃশ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। তাকে সরিয়ে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়ে সেই পুরোনো কাঠামো ভাঙা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, তারা নতুন সচিবকে নানা সময় বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বহীন পদে পাঠাচ্ছেন। এমনকি সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের বদলি বা প্রেষণও তাদের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া ছাড়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সবুর ইনকিলাবকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে জনপ্রশাসন এখন গভীর নৈরাজ্যের মুখে। একদিকে পুরোনো সিন্ডিকেট, অন্যদিকে একটি বিশেষ মহলের প্রভাব। ফলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যদি জনপ্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ পুরোনো সিন্ডিকেটের হাতেই থাকে, তবে নিরপেক্ষ সরকারের পুরো দর্শনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।