Image description

গত প্রায় এক সপ্তাহজুড়ে সমুদ্রসৈকতে বিকিনিপরা এক সুন্দরী বাঙালি নারীর কিছু ‘দুর্লভ’ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে তোলপাড় চলে বাংলাদেশি নেটিজেনদের মধ্যে। অনেক আলোচনা, সমালোচনা। অবশ্য এই তোলপাড় বা আলোচনাটা খুব ভালো দিকে গড়ায়নি। বরং এটি ছিল মূলত একটি নারীবিদ্বেষী এবং যৌনবৈষম্যমূলক এক ধরনের ক্যাম্পেইন। যেই ছবিগুলো এই আলোচনার জন্ম দিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো কোন সত্যিকারের ছবি নয়, বরং নারীবিদ্বেষী ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি করা হয় ছবিগুলো।

বাংলাদেশে নারীদেরকে লক্ষ্য করে অনলাইন হয়রানির ঘটনা নতুন নয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেহরীন আমিন মোনামীকে ঘিরে এই নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। দ্য ডিসেন্ট–এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী ব্যবহারকারীরা একজোট হয়ে মোনামীকে হেয় করার এই ‘সমন্বিত’ প্রচারনায় অংশ নিয়েছেন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন আয়োজনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে বিশ্বাবিদ্যালয় প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল হিসেবে ‘কিছুটা কঠোর’ রূপে দেখা যায় মোনামীকে। এর প্রেক্ষিতে নির্বাচনেও সময় থেকেই মিডিয়াতে তাকে ঘনঘন দেখা গেছে। সেই থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এতে তার যেমন ভক্ত জুটেছে, তেমনি পেয়েছেন সমালোচকও। 

মোনামীর আগের কিছু বক্তব্যের ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন, তিনি নাকি ‘শিবিরপন্থী’। তবে মোনামী স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত নন। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির অভিযোগ করেছেন, ডাকসু নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় মোনামী শিবিরের সদস্যদের ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ দিয়েছেন।

এই ধরনের একটি অনুমান থেকেই শুরু হয় মোনামীর ওপর সাইবার আক্রমণ। মোনামীকে ‘শিবিরপন্থী’ বলে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি —যে দুই দলের সমর্থকেরা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ও মাঠে একে অপরের প্রতিপক্ষ— তাঁর বিরুদ্ধে যৌথভাবে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা শুরু করেন।

দ্য ডিসেন্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক ডজন পোস্ট বিভিন্ন পেইজ ও প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা হয়; যেখানে বিকিনিপরা অবস্থায় মোনামীর ছবি এবং কিছু ক্ষেত্রে তার সাথে ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের কথিত অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ছবি যুক্ত করা হয়েছে। যাচাই করে দেখা যায়, এর প্রতিটি ছবিই সম্পূর্ণ এআই দিয়ে তৈরি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজকর্মী ড. সামিনা লুৎফা দ্য ডিসেন্ট-কে বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী— যে-ই হোন না কেন, কোনো নারীর বিরুদ্ধে এমন প্রচারণা যৌন হয়রানির শামিল।”

তিনি আরও বলেন, “এর বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।”

গত সোমবার (৩ নভেম্বর) বিকৃত ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে শেহরীন আমিন মোনামী শাহবাগ থানায় সাইবার সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করেন।

“মামলা করা হয়েছে, আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি,” দ্য ডিসেন্টকে বলেন শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর। তিনি আরও জানান, “তদন্ত চলছে।”

দ্য ডিসেন্টকে মোনামী বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো রাগ-ক্ষোভ বা বিতর্ককে উস্কে দেয়, কারণ এসব প্ল্যাটফর্ম ‘এনগেজমেন্ট’ থেকে লাভ করে—তা ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক, বিষাক্ত বা আঘাতমূলক।”

তিনি আরও বলেন, “এখন আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি এই চক্রটাকে উৎসাহ দেক, নাকি এমন আলোচনা থেকে নিজেদের দূরে রাখব, যা অন্যের মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে আঘাত করে।”

 

এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও ছড়ালো আ.লীগপন্থী কয়েকটি পেইজ

অক্টোবরের ২৮ তারিখে ‘আমরা আওয়ামী লীগের লোক’ নামের একটি ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও আপলোড করা হয়। ক্যাপশনে লেখা ছিল, “ঢাবির ভিপি সাদিক কায়েমের প্রেম—শিক্ষক শহরীন মোনামীর সঙ্গে, গোপন ক্যামেরায় ধরা।”

ভিডিওটিতে মোনামী ও ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। তবে দ্য ডিসেন্ট যাচাই করে দেখেছে, পুরো ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি।

ভিডিওটি এখন পর্যন্ত ৯৪ হাজারের বেশি বার দেখা হয়েছে, মন্তব্য পড়েছে ২৮১টি এবং শেয়ার হয়েছে ২০৭ বারের বেশি। দ্য ডিসেন্ট বিশ্লেষণে করে দেখেছে এর বেশির ভাগ শেয়ারই করা হয়েছে আওয়ামী লীগ–সমর্থকদের প্রোফাইল থেকে।

আওয়ামীপন্থী প্রোফাইল ও পেইজ থেকে এআই দ্বারা তৈরি ভিডিও পোস্ট করা হয়

পেইজটি তৈরি হয়েছে চলতি বছরের ১৯ মার্চ। এর ‘About’ সেকশনে আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের লিংক দেওয়া আছে। পেজের পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ কনটেন্ট আওয়ামী লীগপন্থী এবং সরকার ও জামায়াতে ইসলামী-বিরোধী।

এর পাশাপাশি, ‘এম. নাসার খান’ নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীও মোনামী ও ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমকে নিয়ে আরেকটি এআই–তৈরি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাঁর প্রোফাইল বায়োতে উল্লেখ আছে, তিনি গ্রিন ইউনিভার্সিটি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

‘Ra Rabi’ নামের আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে মোনামীর বিকিনিপরা একটি ছবি পোস্ট করা হয়, যেখানে তাঁকে জামায়াতের আমিরের সঙ্গে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখা যায়। ছবিটিও সম্পূর্ণ এআই–নির্ভর বলে দ্য ডিসেন্ট–এর যাচাইয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই অ্যাকাউন্টের বায়োতে নিজেকে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, এবং তাঁর অন্যান্য পোস্ট বিশ্লেষণেও দেখা যায়, তিনি দলটির সক্রিয় কর্মী।

এই কয়েকটি পেজ বা প্রোফাইলই নয়, দ্য ডিসেন্ট—আরও কয়েক ডজন আওয়ামী লীগপন্থী ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করেছে যারা একই ধরনের এআই–তৈরি ছবি ও ভিডিও ছড়িয়েছে।

 

মোনামীকে নিয়ে ভুয়া ছবি ছড়াতে যুক্ত বিএনপি সমর্থকরাও

শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই নয়, দ্য ডিসেন্ট–এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপি–সমর্থকরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহরীন আমিন মোনামীকে নিয়ে ভুয়া ছবি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

‘বিএনপি মিডিয়া সেল’ নামের একটি (অফিসিয়াল নয়) ৩৭ হাজারের বেশি সদস্যবিশিষ্ট ফেসবুক গ্রুপে মিলন কাজী নামের একজন ব্যবহারকারী একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেন। কার্ডটিতে লেখা ছিল, “রাতের অন্ধকারে মোনামী ম্যাডামের সঙ্গে পালিয়েছে সাদিক কায়েম।”

ছবিটিতে মোনামী ও ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমকে একসঙ্গে দেখা যায়। যাচাই করে দ্য ডিসেন্ট নিশ্চিত হয়েছে, ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি।

Pro-BNP pages and Profiles shared AI-generated images

বিএনপিপন্থী প্রোফাইল ও পেইজ থেকে এআই দ্বারা তৈরি ছবি পোস্ট করা হয়

এ ছাড়া ‘মুরাদনগর এক্সপ্রেস’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট—যার অনুসারী প্রায় ১১ হাজার—প্রধানত বিএনপি–সমর্থক কনটেন্ট শেয়ার করা হয়ে থাকে। ওই পেজে পোস্ট করা কয়েকটি ছবিতে সাদিক কায়েমকে এক তরুণীর সঙ্গে দেখা যায়। পোস্টের ক্যাপশনে দাবি করা হয়, ওই তরুণী মোনামী। তবে যাচাই করে দ্য ডিসেন্ট নিশ্চিত হয়েছে, ছবিগুলো সম্পাদিত—অন্য এক দম্পতির ছবিতে ডিজিটালভাবে সাদিক কায়েমের মুখ বসানো হয়েছে।

একই পোস্টটি পরে আরও কয়েকজন বিএনপি–কর্মীও শেয়ার করেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেবিদ্বার উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু তাহের মজুমদার ও বিএনপি–কর্মী আবদুল আলিম।