Image description
 

লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনে নতুন করে স্থাপিত ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষার সাইনবোর্ড নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা চললেও নীরব রয়েছেন ব্রিটেনের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ও নেতারা।

এ বিতর্ক এমন এক গভীর বিভেদকে প্রকাশ করেছে, যা লন্ডনের বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়কে স্বাগত জানায় এবং যারা ব্রিটেনের এক-সংস্কৃতির ধারণাকে আঁকড়ে থাকতে চান, তাদের মধ্যে বিদ্যমান। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সাবেক কনজারভেটিভ মেয়র পদপ্রার্থী সুসান হল। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ সাইনবোর্ডটিকে "অগ্রহণযোগ্য" বলে সমালোচনা করে দাবি করেন যে বাসিন্দাদের "ইংরেজি ভাষা শিখতে হবে এবং 'একীভূত' হতে হবে।"

তার এই মন্তব্যের তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় জবাব দেন লন্ডনের মেয়র সাদিক খান। তার কার্যালয় থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানানো হয়, "লন্ডনের বৈচিত্র্যই এর সবচেয়ে বড় শক্তি। মেয়র এই রাজধানীর সব ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত, যা লন্ডনকে বিশ্বের সেরা শহর করে তুলেছে।"

আলতাব আলীর ঐতিহ্য: ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা

সুসান হল এর ভাষাগত সমরূপতার দাবি হোয়াইটচ্যাপেল এলাকার গভীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এই সাইনবোর্ডটি কেবল একটি প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি নয়, বরং এটি এমন একটি গোষ্ঠীর দৃশ্যমান স্বীকৃতি, যারা ইস্ট এন্ডকে নতুন রূপ দিয়েছে এবং যুক্তরাজ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে।

সত্তর ও আশির দশকে ইস্ট লন্ডনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বর্ণবাদী হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এই সময়টি এক মর্মান্তিক চরম পরিণতিতে পৌঁছায় ১৯৭৮ সালে হোয়াইটচ্যাপেলে ২৪ বছর বয়সী পোশাকশ্রমিক আলতাব আলীকে নৃশংসভাবে বর্ণবাদী হামলায় হত্যার মধ্য দিয়ে। তাঁর মৃত্যু এবং কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কমিউনিটিকে এক বৃহত্তর গণআন্দোলনে সংগঠিত করতে বাধ্য করে। হত্যার মাত্র দশ দিন পর আনুমানিক ৭,০০০-এর বেশি বাঙালি এবং বর্ণবাদবিরোধী সহযাত্রীরা আলীর কফিন নিয়ে ইস্ট এন্ড থেকে ডাউনিং স্ট্রিট পর্যন্ত ঐতিহাসিক মিছিল করেন। এই ঘটনা এবং এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত পরবর্তী আন্দোলনগুলো একটি যুগান্তকারী মুহূর্তে পরিণত হয়, যা বর্ণবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্টের ইস্ট লন্ডনে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টাকে প্রতিহত করে। এই আন্দোলন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সম্প্রদায়কে যুক্তরাজ্যের অন্যতম দৃঢ় বর্ণবাদবিরোধী অগ্রবাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করে।

জনসংখ্যার বাস্তবতা: ইস্ট লন্ডনের বাঙালি হৃদপিণ্ড

এই সাইনবোর্ড হোয়াইটচ্যাপেলের জনসংখ্যার বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, টাওয়ার হ্যামলেটস ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের বৃহত্তম বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল, যেখানে মোট জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষত হোয়াইটচ্যাপেল ওয়ার্ডে এই হার আরও বেশি, যেখানে ৩৮ শতাংশ বাসিন্দা বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠীর। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ২০২২ সালের মার্চ মাসে এই সাইনবোর্ডগুলো স্থাপন করে এবং সম্পূর্ণ অর্থায়ন করে, যা এই কমিউনিটির অবদান, ঐতিহ্য এবং অব্যাহত উপস্থিতিকে স্বীকার করে।

বাংলার বাইরে: দ্বিভাষিক স্বীকৃতির পূর্ব দৃষ্টান্ত

হোয়াইটচ্যাপেলের বাংলা সাইনবোর্ডটি "কেবল ইংরেজি" সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দেয়—এই ধরনের ধারণা ঐতিহাসিকভাবে এবং তথ্যের দিক থেকে ভুল। যুক্তরাজ্যের পরিবহন নেটওয়ার্ক দীর্ঘদিন ধরে এর বহু বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে সেবা দিতে বহুভাষিক সাইনেজের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, লন্ডনের সাউথহল স্টেশনে, যা এলিজাবেথ লাইনে অবস্থিত, সেখানেও নব্বইয়ের দশক থেকে স্থানীয় বৃহত্তর পাঞ্জাবি জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিতে ইংরেজি ও পাঞ্জাবি (গুরুমুখী লিপি) ভাষায় দ্বিভাষিক তথ্য স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

সাউথহল ও হোয়াইটচ্যাপেল এশীয় লিপিতে দ্বিভাষিক পরিবহন সাইনেজের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলেও, যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও অ-ইংরেজি ভাষার সাইনেজ রয়েছে। যেমন, লেস্টার স্টেশনে হিন্দি ভাষায় দ্বিভাষিক সাইনবোর্ড রয়েছে, যেখানে লেখা আছে ‘আপনাকে লেস্টারে স্বাগতম’ (लैस्टर आपका स्वागत करता है)।

সুতরাং, হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনের এই সাইনবোর্ড স্থানীয় ভাষাগত কমিউনিটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়ার অংশ, তবে এটি ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সংগ্রামের জন্য একটি অনন্য ও শক্তিশালী স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

নেতৃত্বের নীরবতা বনাম মেয়রের গর্ব

হল এর এই মন্তব্য—দ্বিভাষিক সাইনবোর্ডকে "অগ্রহণযোগ্য" বলা—আসলে রাজনৈতিকভাবে সুযোগসন্ধানী এবং অভিবাসন সংক্রান্ত বিতর্ককে ভোট লাভের হাতিয়ার করার এক ত্রুটিপূর্ণ প্রচেষ্টা। তাঁর বিভেদ সৃষ্টিকারী এক্স পোস্টটি মুছে ফেলা এটাই প্রমাণ করে যে তিনি এর ক্ষতিকারক দিকটি সম্পর্কে অবগত, কিন্তু তার বক্তব্যের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব তাতে দূর হয় না।

এর বিপরীতে, সাদিক খান-এর কার্যালয় আধুনিক লন্ডনের এক আরও গঠনমূলক ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। মেয়রের বহুসাংস্কৃতিকতার পক্ষে অবস্থান ইংরেজি ভাষার উপর কোনো আঘাত নয়, বরং এক সমৃদ্ধ, আরও স্থিতিস্থাপক জাতীয় পরিচয়কে আলিঙ্গন করা।

নাট্যশিল্পী ও ব্রিটেনের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা স্বাধীন খসরু বলেন, হোয়াইটচ্যাপেলের বাংলা সাইনবোর্ডটি ইংরেজির বিকল্প নয়; স্টেশনে ইংরেজি সাইনেজ স্পষ্টভাবেই বজায় আছে। এটি একটি সংযোজন, যা একটি কমিউনিটির জীবনযাত্রা ও ইতিহাসকে সম্মান জানায়—যারা ব্রিটেনের জন্য অনেক কিছু দিয়েছে এবং তাদের স্থানের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে।

তিনি আরও বলেন, “এই বাংলা সাইনটি এবারই প্রথম নয়; অতীতেও এটি বারবার বর্ণবাদী মন্তব্যের শিকার হয়েছে।”

এই সাইনবোর্ডের গুরুত্ব এবং সুসান হল এর মন্তব্যের পর, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাতে বাংলা ট্রিবিউনের জন্য এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনও ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সংসদ সদস্য বা উল্লেখযোগ্য কমিউনিটি নেতা প্রকাশ্যে এই সাইনবোর্ডকে সমর্থন করে এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনের এই আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি।