গত ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সোহেল তাজ। তবে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরও কোনও সবুজ সংকেত না মেলায় বিমানবন্দর থেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি।
ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন রাজনীতি থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকা সোহেল তাজ। তাই তার দেশের বাইরে যেতে না পারার ঘটনায় বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়।
গত ৩০ অক্টোবর বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এহসানুল হক মিলন থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। কর্মকর্তারা জানান, মিলনের বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ রয়েছে।
অবশ্য বিএনপির এই সাবেক মন্ত্রী তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পাসপোর্টজনিত সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারেননি। ওইদিন রাতেই থাইল্যান্ডে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। তবে যাওয়া হয়নি তার। এ ঘটনাও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জন্যও বিদেশ যাওয়া কার্যত বন্ধ। ইমিগ্রেশনে হাজির হলেই গ্রেফতার হতে হচ্ছে তাদের বেশিরভাগের। আর সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাদের জন্যও ইমিগ্রেশন পার হওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে দৃশ্যমান। বিএনপি নেতারা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার না হলেও, তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ কারণে ইমিগ্রেশন নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে।
ব্যাংকক যেতে না পারায় পরে অবশ্য সংবাদ সম্মেলন করেন এহসানুল হক মিলন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার কারণ জানতে চেয়ে সদুত্তর পাইনি। এই সরকার মহান ২৪ গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। আমার দল বিএনপি শুরু থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন দিয়ে আসছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোনও সংস্থা বা বিভাগের কোনও ভুল তথ্য বা ষড়যন্ত্রে তারা বিভ্রান্ত হবে না। আমিসহ দেশের সব নাগরিকের সাংবিধানিক ও নাগরিক, মানবিক অধিকার রক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞায় পড়েন রাজনীতিবীদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, আমলাসহ ও বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, আবার অনেককে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তাদের ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকি। তারা ইমিগ্রেশনে এলে আমরা ফেরত পাঠাই। কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করি। এর বাইরে রাজনৈতিক কারণেও অনেক সময় বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাধা দিই। সেক্ষেত্রে মামলা না থাকলে তাদের গ্রেফতার না করে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগসহ তাদের সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তারা কেউ দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশনে এলে আমরা তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিই। মামলা থাকলে গ্রেফতার করি। মামলা না থাকলেও ফেরত পাঠানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘মূলত এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইমিগ্রেশনে বেশ কড়াকড়ি চলছে। অনেকেই বিদেশ যেতে ইমিগ্রেশেনে নানা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ছেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন; এমন ব্যক্তিদেরও করা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে ফিরে আসতে হচ্ছে অনেককেই।
সম্প্রতি ভ্রমণের জন্য মালয়েশিয়া যেতে চেয়েও বাধা পেয়ে ফিরে আসেন রাজধানীর বনশ্রী এলাকার পলাশ নামের এক ব্যবসায়ী।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার কয়েকটি দেশে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সম্প্রতি তিনি মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশনে গেলেও ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। তার দাবি, ভিসাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব সঠিক ছিল।
তিনি বলেন, ‘ইমিগ্রেশন পুলিশ অনেক সময় যাত্রীদের সঙ্গে একপ্রকার বাড়াবাড়িও করেন। তারা এমন জেরা শুরু করেন যে অনেকে ঘাবড়ে গিয়ে সঠিক তথ্য গুলিয়ে ফেলেন। তখনই শুরু হয় ঝামেলা। তাকে যেতে না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমানে এই সমস্যাগুলো খুব বেশি হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশের ওই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মামলা কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনও নির্দেশনা না থাকলে বৈধ কাগজধারী ব্যক্তি নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পার হতে পারেন। আমাদের পক্ষ থেকে অযথা কাউকে হয়রানি করা হয় না।’
জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) আবু সুফিয়ান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে কিংবা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকলে তাকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়া হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
এই দুই ধরনের ব্যক্তি ছাড়াও সাধারণ ভ্রমণকারীদের ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারকারী দল বেশ সক্রিয়। পাচাররোধে ইমিগ্রেশন পুলিশ সবসময় সতর্ক। তাই সন্দেহজনক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ আমাদের রুটিন ওর্য়াক। জিজ্ঞাসাবাদে কোনও গরমিল না পাওয়া গেলে আমরা কাউকে আটকাই না।’