Image description

মুখ থুবড়ে পড়ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একের এক সিদ্ধান্ত। গত প্রায় এক বছরে বড় কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই করতে পারেনি বেবিচক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্প। দৃষ্টিনন্দন ও ব্যয়বহুল এই মেগা প্রকল্পের ৯৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও নানা কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এমনকি ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার পথে। অথচ এই টার্মিনালকে ঘিরে অ্যাভিয়েশন হাবে পরিণত হওয়ার কথা ছিল।

এছাড়াও কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করার ১১ দিনের মাথায় তা আবার স্থগিত করা হয়েছে। পশু-পাখির অভয়ারণ্য রানওয়েগুলোতে মাঝে মধ্যেই ঝুঁকি তৈরি হয়। শাহজালালের কার্গো টার্মিনালের ভয়াবহ আগুনে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অথচ সতর্ক করে বহুবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও কানে নেয়নি প্রশাসন। বছরের শুরুর দিকে তিন বিমানবন্দরের ১৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাতারাতি চিঠিতে বাতিল করে উচ্ছেদ করা হয়। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় এবং উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার কারণে সেগুলো লিজও দিতে পারেনি। এতে শতকোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বেবিচক নিজেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে এমন লেজেগোবরে অবস্থা কোনও দিনই দেখেনি বেবিচক। একশ্রেণির কর্মকর্তাদের গায়ে না লাগার কারণে মূলত এই অবস্থা। তারা ব্যক্তিগত লাভবান হলেও এক প্রকার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বেবিচক। কোনও কিছুতেই বেবিচক যেন পেরে উঠতে পারছে না। কোথাও যেন এক প্রকার শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে অ্যাভিয়েশন সেক্টর মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেবিচক যে তাদের সিদ্ধান্তগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখানে দক্ষ লোকের অভাব। অতি সম্প্রতি কিছু ঘটনা বেবিচককে বেকায়দায় ফেলেছে। বিশেষ করে হঠাৎ কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আমাদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। যদিও এটি দেশি বিদেশি সংস্থা তদন্ত করছে। এছাড়া কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে পুরোপুরি উপযোগী করে না তোলে আন্তর্জাতিক ঘোষণা, পরে তা স্থগিত করা এটি আমাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।’

কবে এটিকে পুনরায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করা হবে সেটিও অনিশ্চিত। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে এই এয়ারপোর্ট বানানো হয়েছে। চীন এটি করে দিয়েছে। তাদের টাকা দিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘যারা এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে তাদের এখানে অদূরদর্শিতা রয়েছে। থার্ড টার্মিনালকে ঘিরে আমরা কতকিছু দেখলাম শুনলাম। কিছুদিন পরপরই শুনি দ্রুতই চালু হবে। কিন্তু বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে আছে এটি, না পারছে চালু করতে, না পারছে ঠিকাদারের টাকা শোধ করতে। একটা লেজেগোবরে অবস্থা।’

তিনি বলেন, ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে টাকা নিয়ে এটি করা হয়েছে। সেগুলো ফেরত দিতে হবে। এতে আমাদের রাজস্বের ওপর প্রেসার পড়বে। এয়ারপোর্টের ভেতরে ফুডের কিছু দোকান তারা উচ্ছেদ করলেন। এখন এটিও লিজ দিতে পারছে না। উচ্ছেদের স্থানগুলো দেখতে এখন দৃষ্টিকটু লাগে। এর দায় কার। উচ্ছেদের ফলে সেখানকার ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অন্যদিকে সেটি পুনরায় লিজ দিতে না পারার কারণে বেবিচক নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেবিচককে আরও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করতে হবে। হুটহাট কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। প্রয়োজনে যারা এ বিষয়ে এক্সপার্ট তাদের ডেকে পরামর্শ নিতেও পারে। সামগ্রিকভাবে বেবিচকের বর্তমান অবস্থায় অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১ জুলাই শাহজালালসহ তিনটি বিমানবন্দরের লিজ বাতিল করে বেবিচক। অভিযোগ রয়েছে, চুক্তিতে লিজ বাতিলের আগে কমপক্ষে ১ মাস সময় দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও মেম্বার অপারেশনস মেহবুব খান সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের লিজ বাতিল করেন। ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আদালতে রিট করলে আদালত পুনরায় লিজ দেওয়ার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন।

বিমানবন্দরের দীর্ঘ সময়ের এক ব্যবসায়ীর পাঁচটি চলমান প্রতিষ্ঠানের লিজ বাতিল করে ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত রেখে কোটি টাকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রোকের নামে লুটপাট করে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ আছে। এই কাজ করেছে বেবিচক কর্তৃপক্ষের এটিএম বিভাগের কর্মকর্তারা।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অভিযোগে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট কখনও মালিকের উপস্থিত ছাড়া মালামাল ক্রোক করে সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দিতে পারে না। ক্রোকের ক্ষেত্রে অবশ্যই মালিকের উপস্থিতি ও স্বাক্ষর নিতে হবে। এটি আইনে স্পষ্ট বলা আছে, কিন্তু তা করা হয়নি। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি মালামাল ফেরত চাইলেও বেবিচক একটি ভুয়া বিল দাবি করে আটকে রেখেছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগে বলা হয়, সিলেট ও সৈয়দপুরে একটি কুটির শিল্প ও দুটি আন্তর্জাতিক মানের কফি শফের মালিক এক নারী উদ্যোক্তা। তার প্রতিষ্ঠানও জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন মেম্বার অপারেশনস মেহবুব খান। এ কারণে বিমানবন্দরের ব্যবসায়ীরা এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

এমন অবস্থায় নতুন করে লিজও দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এতে বেবিচক প্রায় কয়েক কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পটপরিবর্তনের পর বেবিচকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া। তিনি বেশ কয়েকবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘দ্রুতই চালু করা হচ্ছে থার্ড টার্মিনাল।’ বলা হয়েছে, শতকরা ৯৯ ভাগ কাজই শেষ। কিন্তু গত প্রায় ১ বছরেও এর কোনও অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে এটি কবে চালু হতে পারে সেটিও কেউ বলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় থার্ড টার্মিনালে ব্যবহৃত নানা ধরনের যন্ত্র ক্ষতির মধ্যে পড়েছে।

এদিকে, বিমানবন্দরের রানওয়েতে বার্ড হিটিং যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি রানওয়েতে গরু কিংবা শিয়ালও চোখে পড়ে। যার কারণে উড়োজাহাজগুলো অবতরণের সময় হুমকির মধ্যে পড়ে। এছাড়াও উড্ডয়নের সময় বার্ড হিটিংয়ের ঘটনা ঘটে। এগুলো নিরসনের দৃশ্যত কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। যখনই কোনও ঘটনা ঘটে, তখন কর্তৃপক্ষ বলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একইভাবে শাহজালালে কার্গো ভিলেজে অগ্নিনির্বাপক নিয়ে কয়েকবার সতর্ক করা হলেও ১৮ অক্টোবর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আমদানি করা হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ভস্মীভূত হয়। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কত দুর্বল ছিল এই ঘটনায় তা চোখে পড়ে। ঘটনার পর বেবিচক চেয়ারম্যান এক প্রকার দায় এড়ানোর কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু দাহ্য পদার্থের কারণে আগুনের মাত্রা বেড়ে যায়। যার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে।’

কার্গো সংশ্লিষ্টরা বলেন, আগুনে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে আর তা কাটিয়ে উঠতে কতো সময় লাগবে তা বলা কঠিন। আগে থেকে সতর্কতা ব্যবস্থা থাকলে এত বড় ক্ষতি এড়ানো যেতো।

সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করা হয়। এর ১১ দিনের মাথায় তা আবার বাতিল করা হয়। পুরোপুরি কাজ শেষ না করে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত হয়ে আন্তর্জাতিক ঘোষণা, পরে তা বাতিল করায় দেশে-বিদেশে বেবিচকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ এ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে অপরিপক্বতা রয়েছে। এখানে দক্ষ ও পেশাদারিত্ব জনবলের অভাব সেটি স্পষ্টতই ফুটে উঠছে। কার্যকরী কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। যার কারণে সঙ্কটের মুখে পড়ছে বেবিচক। গত এক বছরে বড় কোনও সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেনি বেবিচক।

এদিকে নাম প্রকাশ না করা শর্তে বেবিচকের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বর্তমানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতা চেয়ারম্যানের থাকলেও মেম্বার অপারেশন, মেম্বার প্রশাসনই নিয়ে থাকে। তাদের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকরী তা এখন বোঝা যাচ্ছে। তারা প্রত্যেকটা জায়গায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যে কাজগুলো করার দরকার সেগুলো না করে অপ্রয়োজনীয় কাজগুলোই বেশি হচ্ছে।’

তারা বলছেন, থার্ড টার্মিনাল চালু করতে আগে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। তারা ১ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে। আবার থার্ড টার্মিনালে বসানো যন্ত্রপাতির মেয়াদের একটি বিষয় রয়েছে। সদস্য অপারেশন ও সদস্য প্রশাসন এর দায়ভার এড়াতে পারেন না। একইভাবে আগুনের দায়ভারও তাদের ওপরই বর্তায়। সামগ্রিকভাবে সদস্য অপারেশন ও সদস্য প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন।

তাদের দাবি, গায়ে না লাগিয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে আজ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বেবিচক। তারা নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও বড় আর্থিক সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে।

এ বিষয়ে বেবিচকের সদস্য প্রশাসন এস এম লাবলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তো পেশাদারিত্বের সঙ্গেই কাজ করে যাচ্ছি। অনেক সময় বেবিচক একা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। আমরা থার্ড টার্মিনাল চালুর ব্যাপারে কাজ করছি। হয়তো দেখা যাচ্ছে আমরা প্রস্তুত, অন্যান্য সংস্থা সময় নিতে চায়। এ কারণে দেরি হচ্ছে।’

কক্সবাজার বিমানবন্দরের বিষয়ে বলেন, ‘এটা তো সরকারি সিদ্ধান্ত। সরকার চেয়েছিল আন্তর্জাতিক করতে। পরবর্তীতে আবার না করেছে। আবার হয়তো ঘোষণা আসবে।’

অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা তো সরকার দেখছে। সরকার দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে।’ বিমানবন্দরের ভেতরের লিজ বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ ইচ্ছে করে কোনও কাজ করছে না। আমরা মঙ্গল বা ভালোর জন্যই সিদ্ধান্ত নেই। আর অনেক সময় বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নেওয়া হয়।’

দেশের বাইরে থাকায় সদস্য অপারেশনস মেহবুব খানের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।