Image description
৯ মাসে ৫০১৭ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪৯৭১ জন

ঝালকাঠির নলছিটিতে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দপদপিয়া জিরো পয়েন্ট এলাকায় ২৯ অক্টোবর সকালে একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চায়ের দোকান ভেঙে খাদে পড়ে। এতে দোকানের ক্রেতা, মাইক্রোবাস আরোহীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাইক্রোবাসের চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, যার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

এভাবেই প্রতিদিন বিভিন্ন গণপরিবহণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ চলাচল করছেন। মালামাল নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলছে মালবাহী ট্রাক। অধিকাংশ চালক শারীরিকভাবে ফিট থাকেন না, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সম্প্রতি এক জড়িপে দেখা যায়, দেশের ৭৯ ভাগ চালক শারীরিকভাবে আনফিট। তাদের উচ্চ বা নিু রক্তচাপজনিত সমস্যা প্রকট। চোখের দৃষ্টিস্বল্পতা সমস্যায় ভুগছে ৭৫ ভাগ চালক। ৬২ ভাগের ডায়াবেটিস রয়েছে। ৩৫ ভাগ চালক রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস উভয় সমস্যায় ভুগছে। ৭৫ ভাগ ড্রাইভার তাদের শারীরিক সমস্যার বিষয়টি জানেই না। এ ধরনের চালকদের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে আহত ও নিহতের সংখ্যাও। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৫ হাজার ১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৯৭১ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১০ হাজার ১৮৩ জন।

ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) আয়োজিত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও চক্ষুশিবির থেকে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল স্টুডেন্টস সোসাইটির হেলথ প্রফেশনাল গ্রুপ ৯৩৬ জন চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাদের শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ চিত্র পেয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নানা জটিলতা দেখা যায়। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে মাথা ঘোরা, হাত-পা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা দেখেন চালক। গাড়ি চালানো অবস্থায় হঠাৎ জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারেন। এতে যে কেনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, চালকের উচ্চরক্তচাপ থাকলে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। সুতরাং এসব সমস্যা যেসব চালকের আছে, তাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। না হলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম চালকদের স্বাস্থ্যগত ত্রুটি, অর্থাৎ গাড়ি চালানোর জন্য ফিট না থাকা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩৫ হাজার ৭৯২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮ হাজার ২২৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬১ হাজার ৭০ জন। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৫ হাজার ১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৯৭১ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১০ হাজার ১৮৩ জন।

জানা যায়, জুলাই বিপ্লব উপলক্ষ্যে চালকদের জন্য চলতি বছরের ২৯ থেকে ৩১ জুলাই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। রাজধানীর ৫টি স্থানে স্বাস্থ্য ও চক্ষুশিবির পরিচালিত হয়। এগুলো হলো গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল এবং বিআরটিসি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট/সেন্টার তেজগাঁও ও সায়েদাবাদ। এই স্বাস্থ্যশিবিরের মাধ্যমে চালকদের রক্তচাপ, রক্তে শর্করা, জীবনধারা সম্পর্কিত তথ্যসহ ধূমপানের অভ্যাস, তামাক ব্যবহার, অবৈধ ওষুধের ব্যবহার, বিশ্রামের সময়, দৃষ্টি পরীক্ষাসহ সাধারণ স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে চালকের স্বাস্থ্যগত ত্রুটি। অনেক চালক তার ত্রুটির বিষয়টি জানেনই না। তাদেরই একজন যশোরের কেশবপুরের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান। তিনি ৩০ বছর ধরে কখনো বাস আবার কখনো ট্রাক চালান। পঞ্চাশোর্ধ্ব মতিয়ার যুগান্তরকে জানান, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে শরীরের কোনো পরীক্ষা করাননি। শারীরিক অবস্থা গাড়ি চালানোর উপযোগী কি না, তাও তার জানা নেই। শুধু মতিয়ার নন, এ অবস্থা দেশের অধিকাংশ চালকের।

আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে চালকদের বিষয়ে নানা তথ্য। লাইসেন্স সম্পর্কিত বিষয়ে জানা গেছে, ৫৩ ভাগ চালকের ভারী ধরনের লাইসেন্স আছে। আর ২৬ ভাগের হালকা এবং ২১ ভাগের মাঝারি ধরনের লাইসেন্স রয়েছে। চালকদের মধ্যে ৭৯ ভাগের রক্তচাপের সমস্যা (উচ্চ বা নিু) পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৬৫ ভাগের উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা রয়েছে। এছাড়া চালকদের ৬২ ভাগের ডায়াবেটিস অর্থাৎ রক্তে শর্করার সমস্যা (স্বাভাবিক সীমার উপরে) পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৭ ভাগের রক্তে শর্করার উচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে। ৩৫ ভাগ ড্রাইভার রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করা উভয় সমস্যায় ভুগছে।

প্রতিবেদনে চোখের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৭৫ ভাগ ড্রাইভারের দৃষ্টি সমস্যা রয়েছে। সায়েদাবাদ বাসটার্মিনালে ৮০ ভাগ এবং মহাখালীতে ৭৯ ভাগ ড্রাইভারের এমন সমস্যা পাওয়া গেছে।

পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে আহ্ছানিয়া মিশনের পক্ষ থেকে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। সেগুলো হলো, লাইসেন্সের জন্য আবেদনের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও চোখের ফিটনেস সার্টিফিকেট সংযুক্ত বাধ্যতামূলক করা, নবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বাধ্যতামূলক নিয়মিত দৃষ্টি পরীক্ষা করা। ড্রাগ বা অ্যালকোহলের প্রভাবে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে কঠোর নিয়মগুলোকে শক্তিশালী ও প্রয়োগ করা, সঠিক বিশ্রামের সময় নিশ্চিত করতে চালকদের কাজের সময় ঠিক করা, সহজলভ্য দৃষ্টি স্ক্রিনিং, চিকিৎসা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের সংশোধনমূলক লেন্স প্রদানের জন্য চোখের যত্নে জড়িত সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদার হওয়া।