Image description
দীর্ঘদিনের মিত্রই এখন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী!

দূরত্ব বাড়ছে বিএনপি-জমায়াতের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দীর্ঘদিনের দুই মিত্র নানা ইস্যুতে এখন বিপরীত অবস্থানে। একসঙ্গে সরকারে এবং দীর্ঘদিন রাজপথে থাকা দল দুটির প্রভাবশালী নেতারা প্রকাশ্যে একে অন্যের কড়া সমালোচনা করছেন। তুলছেন নানা অভিযোগ। নির্বাচনি শোডাউন বা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের তৃণমূল নেতাকর্মী-সমর্থকরা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে জামায়াতের। ঘটেছে হতাহতের ঘটনাও। নানা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দল দুটির কর্মী-সমর্থকদের পরস্পরের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা ও বাহাস থেমে নেই। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ট্রান্সফরমেশন (রূপান্তর) নতুন করে হচ্ছে। এখানে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে চায়। আবার জামায়াতও। ফলে নতুন করে একটা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিযোগিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে পাশাপাশি পথচলা দু-দলকেই দায়িত্বশীল আচরণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এখন তিনটি বড় পার্টি নতুন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রি-কনফিগারেশন হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির যে ট্রান্সফরমেশন, এটা নতুন করে হচ্ছে। এই রূপান্তরে দেখা গেছে, এখানে বিএনপিও ক্ষমতায় আসতে চায়। আবার জামায়াতও। আগের যে ক্যালকুলেশন-জামায়াত ও বিএনপি মিলে অন্য একটা বড় দলের সঙ্গে ফাইট করা। সেই অবস্থা এখন নেই। ফলে ইন্টারনালি এখানে নতুন করে একটা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, জুলাই-পরবর্তী সময়ে সহিংসতার ধরন ও পক্ষ-বিপক্ষ এখন পরিবর্তন হচ্ছে। অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অন্য বিভিন্ন অধিকারভিত্তিক সংগঠন কিন্তু এমন তথ্যই দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন-আপনি ব্যাপারটা কীভাবে দেখবেন? আদর্শিকভাবে নাকি রাজনৈতিকভাবে? রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্ন হলে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। দ্বিমুখী, ত্রিমুখী সংঘর্ষ ঘটতে পারে। কারণ, ইতোমধ্যে জুলাই সনদসহ আরও কিছু বিষয়ে দেখতে পাচ্ছি যে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্কের কিছুটা ঘাটতি হয়েছে। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণের পরামর্শও দেন তিনি।

২০২২ সালে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হয়। পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে দলগুলো অনেকটা কাছাকাছি থেকে মাঠে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। আওয়ামী সরকার পতনের পর প্রথম বিরোধ দেখা দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে। এরপর সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের ছড়াছড়ি, আধিপত্য বিস্তারকে কন্দ্রে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন নেতাকর্মীরা। এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছে।

গত ২২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার জামায়াত ও বিএনপি সমর্থনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৯ জন আহত হন। ১৯ অক্টোবর নোয়াখালী সদর উপজেলায় মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে বিরোধের জেরে বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হন। ৩ অক্টোবর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপি ও জামায়াতকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল বাজারে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের মধ্যে পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন বেশ কয়েকজন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির ২০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন দুই দলের অন্তত ২১৬ জন নেতাকর্মী। এ সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির ৩০টি সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যু হয় আটজনের এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৪১২ জন।

দুই দলের বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা এখন সভা-সেমিনারে নেতাদের বক্তব্যে প্রকাশ্যে আসছে। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হলে তা প্রতিহত করা হবে।

একই অনুষ্ঠানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তৎকালীন সরকারের কাছ থেকেও জামায়াত সুবিধা পেয়েছিল অভিযোগ করে আলাল বলেন, জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতা একসময় জাসদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, গলা কাটা পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে শিবিরের অনেক সদস্য ছাত্রলীগের ভেতর থেকে বের হয়েছেন আর এখন তারা বলছেন, তারা প্রকাশ্যেই ছিলেন।

বিএনপির বিরুদ্ধেও কথা বলছেন জামায়াত নেতারা। শুক্রবার কুমিল্লায় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এতগুলো রাজনৈতিক দলের সময় নষ্ট করে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে সবাই যখন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, তখনই বিএনপি সংস্কারের বিরোধিতা করছে। আমি মনে করি, এটি বিএনপির দায়িত্বহীনতার পরিচয়। বিএনপি পরিকল্পিতভাবে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরির একটি অপকৌশল অবলম্বন করেছে তারা।

সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার বিরোধ প্রসঙ্গে যুগান্তরের এক সেমিনারে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আপনারা কেন আজ বিভক্ত হয়ে গেছেন? শুধু ভাগে কমবেশি এজন্য? আমার কথাটা শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে। এই যে ভাগের রাজনীতি, আমি নিশ্চিত নির্বাচন শেষ হলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না। যে প্রবণতা আমাদের মধ্যে বিরাজমান, এটা যদি এক্সিস্ট করে, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আমি এগুলো সমাধানের জন্যই বলছি। আমি মনে করি, এটার সমাধান করতে হলে সমঝোতামূলক একটা জায়গায় যেতে হবে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন এ জোটে শরিক দল ছিল জামায়াতে ইসলামীও। এই জোট ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার বিরোধী দলে চলে যায়। পরে চারদলীয় জোট থেকে ১৮ দলীয় জোট এবং তারপর পরিধি বেড়ে হয় ২০ দলীয় জোট। সেখানে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে ছিল।