Image description
 

কুষ্টিয়ায় স্বাস্থ্য সহকারীসহ ১১৫টি বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্যের গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শুরু হয়ে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গত ১৫ মাসে ১১-২০তম বেতন গ্রেডের দুই শতাধিক চাকরী প্রার্থীর নিকট থেকে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ বাণিজ্য করেছেন এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।

 

এই নিয়োগ বাণিজ্য সফল করার প্রথম ধাপেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ফেঁসে গেছেন সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের সংশ্লিষ্টরা। এমনই সত্যতার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান উদ্ভূত পরিস্থিতে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম স্থগিতসহ বাতিল ঘোষণার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

 

গত ২৭ অক্টোবর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগ ও দুদকের যৌথ তদন্তকারী দলের হাতে উঠে আসা তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২৩ অক্টোবর দুপুরের পর থেকে ২৪ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষার দিন সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঘটনা বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

 

ঘটনার দিন সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং শহরের কোর্টপাড়াস্থ হাসপাতাল মোড় এলাকার বাসিন্দা বিএনপি ও সাবেক ব্যাংক সিবিএ নেতা কুতুব উদ্দিনের পূত্র কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. হোসেন ইমাম ও তার বড় ভাই স্বাস্থ্য সহকারী হাসান ইমাম নান্নুর বাড়ি এবং তার মালিকানাধীন নিউ সান নামে প্রাইভেট ক্লিনিকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা।

সেইসাথে ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত নিয়োগ কমিটির কতিপয় ব্যক্তি এবং তাদের পারিপার্শ্বিক গতিবিধি ও আচরণের মধ্যেই প্রশ্ন ফাঁসের সকল তথ্য প্রমাণ উঠে এসেছে, যা স্বাস্থ্য বিভাগ ও দুদকের যৌথ তদন্তে জব্দকৃত আলামতে প্রাথমিক ভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রমাণে জড়িতদের সনাক্তকরণে যথেষ্ট বলে মনে করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এছাড়াও এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার আন্দোলনে জেলাজুড়ে তোলপাড় হওয়ায় এনএসআই, ডিজিএফআই বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় সকল গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠে নামে জড়িতদের খুঁজে বের করতে। এসব তদন্তকারী সংস্থাগুলি তাদের তদন্তে ভিন্ন ভিন্ন অনুসন্ধানী কৌশল অবলম্বন করলেও উদ্ঘাটিত তথ্য প্রমাণের সাদৃশ্য রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ‘২৩ অক্টোবর রাত ১০টার পূর্বে ও পরে সিভিল সার্জন কার্যলয়ের সিসি ক্যামেরার অংশ বিশেষ ফুটেজে বেশকিছু সন্দেহজনক আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায় যার সাথে প্রশ্ন ফাঁসের আলামত পাওয়া যায় যার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজের যোগসূত্র রয়েছে।’

সিভিল সার্জন অফিসের ওয়েভ সিস্টেম/ওয়াইফাইয়ের সুইচ অফ থাকলেও প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির কতিপয় ব্যক্তির নিয়ম বহির্ভুত ব্যক্তিগত ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটি ঘটেছে। ওই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে- নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৬ হাজার ৭৮৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২ শতাধিক প্রার্থীর কাছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে এই পশ্নপত্র প্রেরণ করা হয়।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জনবল নিয়োগে ৫ সদস্য বিশিষ্ট নিয়োগ কমিটি কাজ করেন। সদস্যগণ হলেন- খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মুজিবুর রহমান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব মো. শাহাদত হোসেন কবির, পিএসসি খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক নাসরিন সুলতানা, সিভিল সার্জন কুষ্টিয়া ডা. শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন এবং কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক মো. জাহাঙ্গীর আলম। এই নিয়োগ কমিটিই ২৩ অক্টোবর দুপুর থেকে বিরতিহীন ভাবে ২৪ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রশ্ন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন। কঠোর নিরাপত্তা ও শতভাগ গোপনীয়তা সুরক্ষায় বিধি অনুযায়ী এধরনের দায়িত্ব পালনকালে কেবল অনুমোদিত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জাম ব্যবহার ব্যতিরেকে কর্তব্যরত ব্যক্তিগণ সকল প্রকার নেট ওয়ার্ক ও ডিভাইস বিচ্ছিন্ন থাকবেন।’

পিএসসি খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক নাসরিন সুলতানা’র সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জনবল নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নকালে স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি কাজের চাপ থাকায় আমি নিজেও খুব ব্যস্ত ছিলাম। বিধিমতে, এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে কর্তব্যরত কেউই ব্যক্তিগত কোন ডিভাইস ব্যবহার করার কথা না। আমার নিজের ডিভাইস/মোবাইলটাও জমা দেওয়া ছিলো। এসময় সেখানে কেউ মোবাইল বা ব্যক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার করেছেন কি না সেটা আমি বলতে পারব না।’

স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নকালে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ব্যক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চেয়ে মুঠোফোনে আলাপ হয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব মো. শাহাদত হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর বলেন, ‘এই মুহূর্তে এ বিষয়ে আমি কোন কিছুই বলতে পারব না। পরে অন্যকোন সময় কথা বলা যাবে।’

নিয়োগ কমিটির অপর সদস্য কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাাসক (সার্বিক) মো. জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে দুই দিন ধরে কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। কল রিসিভের অনুরোধ করে খুদে বার্তা দিলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। পরে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটিকে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’