Image description

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের প্রথম গণভোটের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ৪৮ বছর আগে, সেই হ্যাঁ/না ভোটের ফল ঘোষণা করতে সময় লেগেছিল ৩০ ঘণ্টা।

১৯৭৭ সালের সেই গণভোটের পর ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে আরও দুটি গণভোট হয়েছে বাংলাদেশে। আর এবার চতুর্থবারের মত গণভোট আয়োজন করতে সরকারের কাছে সুপারিশ রেখেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা হস্তান্তর করা হয়। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন বা আগে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট করার কথা বলা হয়েছে সেখানে।

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা এটা লিখিতভাবে বলেছি। এর বাইরে আমরা সরকারকে আজ বলেছি, অবিলম্বে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে আলাপ আলোচনা করে যেন একটি তফসিল, (গণভোট) নির্বাচনের তফসিল তৈরি করে ফেলে।”

রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে

অর্থাৎ, তফসিল ঘোষণার বাকি রয়েছে দেড় মাস। এরই মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত পেলে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটিকে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে সাজাতে হবে গণভোটের কর্মপরিকল্পনা।

যেভাবে হয়েছিল প্রথম গণভোট

দেশের প্রথম সিইসি বিচারপতি মুহাম্মদ ইদ্রিছ এবং নির্বাচন কমিশনার নূর মোহাম্মদ খাঁ- দুই সদস্যেরে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম গণভোট হয়েছিল।

১৯৭৭ সালের ৩০ মে ‘হ্যাঁ/না’ ভোট চলে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা। পুরো দেশের ফলাফল পেতে সময় লেগেছিল ৩০ ঘণ্টা। পৌনে চার কোটি ভোটারের নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ২ কোটি ৫ লাখ টাকা।

তৎকালীন সিইসি ও ইসি স্বাক্ষরিত এ ভোটের প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই।

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তার নীতি ও কাজের প্রতি আস্থা যাচাইয়ে সেই গণভোট হয়। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এ প্রশ্নে আস্থা ও অনাস্থা প্রকাশের ক্ষমতা দেওয়া হয় ভোটারদের।

সেই নির্বাচন কমিশনের ফলাফলের প্রতিবেদনে বলা হয়, “এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের নজির শুধু বাংলাদেশে কেন, উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এই প্রথম।”

‘অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ও আনন্দমুখর পরিবেশে’ সেই গণভোট হওয়ার কথা লেখা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, মোট ভোটারের ৮৮.০৫ শতাংশ সেই নির্বাচনে ভোট দেন। আর প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ৯৮.৮৮ শতাংশ পড়ে ‘হ্যাঁ’ ভোট।

ভোটের ওই ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা কথা চালু আছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও কেউ কেউ ভোটের ওই হার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

একনজরে সেই গণভোট

প্রতিবেদনে বলা হয়, “গণভোটের দিন ভোট গণনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের দূর দূরান্ত হইতে টেলিফোনযোগে বেসরকারি ফলাফল সংগ্রহ করিয়া বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ইহা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। ৩০শে মে সন্ধ্যা ৬ ঘটিকা হইতে পরবর্তী ৩০ ঘণ্টার মধ্যে সমগ্র ফলাফল সংগ্রহ ও প্রচার সমাপ্ত হয়।”

>> ৩০ মে সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পযন্ত একটানা ভোট চলে।

>> ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন ১ লাখের বেশি।

>> ভোটকেন্দ্র ছিল ২১,৭৭০টি। ভোট কক্ষ ৫৮,৩০২টি।

>> ৬২ মহকুমা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন ৭৫৯ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ২১ হাজার ৭৭০ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৫৮ হাজার ৩০২ জন সহকারী প্রিজাইডিং এবং ৫৮ হাজার ৩০২ জন পোলিং অফিসার।

>> ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্র ছিল ১৫,৬৭৮টি; গণভোটে বাড়ে আরও সাড়ে পাঁচশ কেন্দ্র।

>> ভোটর ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন (১৯৭৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত তালিকা)।

>> গণভোটে প্রদত্ত বৈধ ভোটের মোট সংখ্যা ৩,৩৭,৭৯,৭৬৮টি।

>> ‘হ্যাঁ’ ভোটের সংখ্যা ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭০ এবং ‘না’ ভোটের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৮টি।

>> ভোটারদের ৮৮.০৫% ভোট দেন। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ৯৮.৮৮% এবং অনাস্থা-সূচক ‘না’ ভোট ১.১২%।

>> গণভোটের একীভূত ফলাফলের গেজেটে প্রকাশ হয় ৮ জুন।

রাষ্ট্রপতির ভাষণে গণভোট ঘোষণা ও আইন জারি

নির্বাচন কমিশনকে সেই গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে।

রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল দেশের রাষ্ট্র-প্রধানের দায়িত্ব নেন। পরদিন রাষ্ট্রপতি হিসাবে জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন।

সেখানে তিনি ঘোষণা দেন, তার প্রতি জনসাধারণের আস্থা যাচাই করার জন্য ৩০ মে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশব্যাপী একটি গণভোট হবে।

৩০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া আরেক ভাষণে তার অনুসৃত নীতি ও ১৯ দফা কর্মসূচি তুলে ধরেন।

এ ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেন, "গণতন্ত্রের প্রতি আমার অবিচল আস্থার নিদর্শনস্বরূপ আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে আমার অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থা এবং আমার নিজের উপর আপনাদের আস্থা যাচাই করার জন্য আমি ৩০শে মে গণভোট যোষণা করেছি।”

গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১ মে ‘গণভোট আদেশ, ১৯৭৭ (১৯৭৭ সনের ১ নম্বর সামরিক আইন আদেশ) নামে একটি আইন জারি করেন।

এ আইনের মূল বৈশিষ্ট্য হল–নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণাধীনে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোট হবে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে।

প্রশ্ন কী ছিল?

সেই গণভোটে ব্যালট পেপারে প্রশ্ন ছিল–রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বি. ইউ, এবং তার অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আপনার আস্থা আছে কি?

>> ভোট দানের পদ্ধতি: প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রের পোলিং বুথের মধ্যে একটি গোপন কামরায় ছিল দুটি ব্যালট বাক্স।

>> দুটি বাক্সের মধ্যে একটির গায়ের চতুর্পাশে রাষ্ট্রপতির ছবি এবং এর নিচে ‘হাঁ’ শব্দটি লেখা কাগজ লাগানো ছিল।

>> অন্য বাক্সের নিচের অংশে ‘না’ শব্দ লিখিত কাগজ লাগানো ছিল।

>> ভোট দেওয়ার পর বাষ্ট্রপতির ছবি লাগানো ব্যালট বাক্সে ‘হ্যাঁ’ ব্যালট পেপার আর অনাস্থা ভোটের ব্যালট পেপার ‘না’ বাক্সে ফেলেন ভোটাররা।

কারা দায়িত্বে ছিলেন

১৯৭৭ সালের ১ মে গণভোট আদেশের গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করে।

আদেশের ৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন দেশের ৬২টি মহকুমার মহকুমা প্রশাসকগণকে তাদের নিজ নিজ এলাকার জন্য রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়।

ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (উন্নয়ন) রিটার্নিং অফিসার করা হয়। রিটার্নিং অফিসারদের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ২ মে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন বিভাগের থানা পর্যায়ের সরকারী অফিসারদের মধ্যে থেকে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য মোট ৭৫৯ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ভোট অনুষ্ঠানের জন্য ভোটকেন্দ্র স্বাপন, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ, প্রিজাইডিং অফিসারদের মধ্যে ভোটার তালিকা, ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার ও অন্যান্য দ্রব্যাদির বণ্টন করতে হয়।

এবারের গণভোটে কী প্রশ্ন থাকবে

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট হবে। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এ আদেশ এবং এর তফসিলে সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।

গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।

গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে–“আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”

ভোটারদের এই প্রশ্নে ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে বাক্সে ফেলতে হবে।