Image description
♦ আদেশ, গণভোট ও নোট অব ডিসেন্ট ♦ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা আজ

জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্তের পর এবার বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করে তা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ দুপুর ১২টায় বাস্তবায়নের সুপারিশ গ্রহণ করবেন। আর এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টানা আট মাসের জার্নি শেষ হচ্ছে। সনদ বাস্তবায়নের জন্য রাখা হচ্ছে বিকল্প প্রস্তাব। এ ক্ষেত্রে আদেশ জারির এখতিয়ার, গণভোট অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের কাঁধে।

জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের রূপরেখা অনুযায়ী, প্রথমে একটি আদেশ জারি করা হবে। এর নাম হবে ‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’। এ আদেশের ভিত্তি হবে গণ অভ্যুত্থান। এর অধীনে গণভোট নিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে। এ অধ্যাদেশের ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। এতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ত্রয়োদশ সংসদ) দিয়ে সনদের সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ রাখা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের আরেকটি বিকল্প পদ্ধতিও সুপারিশ করছে। সেখানে শুধু গণভোটের বিষয়টি আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে একটি বিল আকারে উপস্থাপন করে তার ভিত্তিতে গণভোট করার কথা বলা হয়েছে। এদিকে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কি রাষ্ট্রপতি জারি করবেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন, এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার বর্তমান সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া বহুল আলোচিত ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত এবং বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশারদদের অভিমতের ভিত্তিতে সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে কমিশন। এজন্য তাদের বৈঠক করতে হয়েছে দেড় শতাধিক। শেষ কয়েক দিনে বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশারদদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে কমিশন।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান গ্রহণের পরামর্শ থাকছে কমিশনের। কমিশন ভাবছে তারা বাস্তবায়নের যে সুপারিশই দিক না কেন, সব দল সেটা মেনে নেবে না। দলগুলোর পক্ষে প্রতিবাদ আসবেই। কারণ সব দলকে খুশি করার মতো সুপারিশ তৈরি করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে শক্ত অবস্থান নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পাশাপাশি আইনি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয়ে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকার ওই সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন। মঙ্গলবার (আজ) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দেবে।

এর আগে গতকাল বিকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনের সদস্যরা। সেখানে সনদ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সুপারিশ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সমাপনী বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পর থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ দেওয়া পর্যন্ত সব ডকুমেন্ট, আলোচনার ভিডিও, অডিও, ছবি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এগুলো মহামূল্যবান সম্পদ। জাতি হিসেবে আমরা কোন প্রেক্ষাপটে কী প্রক্রিয়ায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, তা সবার জানার জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উন্মুক্ত থাকা দরকার। যত বৈঠক হয়েছে সেগুলোর ছবি ও ভিডিও, যত চিঠি চালাচালি হয়েছে সব ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে হবে এবং ক্যাটাগরি করে রাখতে হবে। টেলিভিশনে যেসব আলোচনা লাইভ প্রচার হয়েছে সেগুলো খ খ আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, এগুলো হবে ইতিহাসের চিরজীবন্ত দলিল। যারা গবেষণা করতে চান তারা যেন এগুলো দেখে কাজে লাগাতে পারেন। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ডকুমেন্ট থেকে যাবে। এ দলিলগুলোই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। এ সময় রাজনৈতিক দল, ঐকমত্য কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা। সমাপনী বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কমিশন সদস্যরা।

কমিশন জানিয়েছে, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে প্রথমে একটি বিশেষ আদেশ জারি, এরপর গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৭টি প্রস্তাব সংবিধান-সম্পর্কিত। মূলত এ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। এ প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এর মধ্যে ৭টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বিএনপির।

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনগুলোর দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্বে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত পৃথক সংলাপ করে। দ্বিতীয় পর্বে ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ২ জুন থেকে ৩০টি দলকে একসঙ্গে নিয়ে সংলাপ শুরু করে কমিশন। যা ৩১ জুলাই শেষ হয়। এরপর সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে তৃতীয় দফায় সংলাপ শুরু এবং ৮ অক্টোবর তা শেষ করে। এখন সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামী ৩১ অক্টোবর এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে।