Image description
দেশটা যাচ্ছে কোথায়?

ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা ২৫ মিনিট। নোয়াখালী থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রাবিরতির জন্য ভৈরব রেলওয়ে জংশনে থামছিল। এ সময় ভৈরব জেলার দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথ অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীরা ট্রেনটিকে আটকে দেন। শুরু হয় অবরুদ্ধ ট্রেনটিকে ঘিরে বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের অনেকে তখন ট্রেনের ইঞ্জিনে চেপে বসেন, অনেকে ট্রেনের সামনে বসে পড়েন, অনেকে রেলপথে দাঁড়িয়ে যান। অনেকে আবার প্ল্যাটফরমে বিক্ষোভ করেন। তখন স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল ভৈরব রেলওয়ে জংশন এলাকা। লাল কাপড় ও ব্যানার হাতে নিয়ে জেলার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এতে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের রেল যোগাযোগ। বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত করতে ভৈরব সার্কেলের এএসপি নয়ন আহমেদ, ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ খন্দকার ফুহাদ রুহানী, স্টেশন মাস্টার মো. ইউসুফ, রেলওয়ে থানার ওসি সাঈদ আহমেদসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চেষ্টা করেন। 

ট্রেনটি থেকেও একাধিকবার হুইসেল বাজানো হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বদলে যায় দৃশ্যপট! অবরুদ্ধ ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে শুরু হয় পাথর নিক্ষেপ। অন্তত ১৫ মিনিট ধরে চলে বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ। ভাঙচুর চালানো হয় ট্রেনটিতে। পাশাপাশি হামলাকারীরা মাতেন পৈশাচিক উল্লাসে। এ রকম পরিস্থিতিতে ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় আর্তচিৎকার। অনেকে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন। বর্বর এই হামলায় ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগির কাঁচ ভাঙচুর করা হয়। পাথরের আঘাতে ট্রেনটির অন্তত ২০ যাত্রী আহত হন। নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে অবরোধ তুলে নেয়ার দুই মিনিট পর ১১টা ৪২ মিনিটে বিধ্বস্ত ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ভৈরব ছেড়ে যায়। এই ঘটনার ভিডিও ও ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর নেটিজেনরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ধিক্কার ওঠে চারদিকে। দাবি আদায়ের কর্মসূচিকে বর্বরতায় পরিণত করায় ঘৃণাও প্রকাশ করেন অনেকে। যাত্রীবাহী ট্রেনে নজিরবিহীন এই তাণ্ডবের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন নেটিজেনরা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ভৈরবকে জেলা ঘোষণার দাবিতে সোমবার সকাল ১০টায় রেলওয়ে স্টেশনে জড়ো হয়ে রেলপথ অবরোধ করেন ছাত্র-জনতা। বেশ কিছুদিন ধরে চলা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভৈরব জেলার দাবিতে রেলপথ অবরোধ কর্মসূচিতে নামেন আন্দোলনকারীরা। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ঢাকাগামী উপকূল এক্সপ্রেস ভৈরব স্টেশনে প্রবেশের সময় অবরোধকারীরা ট্রেনটিকে আটকে দেন। অবরোধ আতঙ্কে কালনি এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেসসহ বেশ কিছু ট্রেন পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্টেশনে অপেক্ষমাণ থাকে। এ সময় উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে ঘিরে ভৈরব রেলওয়ে জংশন বিক্ষোভ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে। ‘জেলা জেলা জেলা চাই, ভৈরব জেলা চাই’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, কিশোরগঞ্জ নো মোর’, ‘ইন্টেরিম সরকার, জেলা মোদের দরকার’ ইত্যাদি স্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা। 

এ সময় চরম ভোগান্তিতে পড়েন বিদেশগামী যাত্রীসহ শত শত সাধারণ ট্রেনযাত্রী। দীর্ঘ এক ঘণ্টা অবরোধ-বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে চললেও বেলা ১১টা ২৫ মিনিটের দিকে সহিংস হয়ে ওঠে আন্দোলনকারী একটি গ্রুপ। তারা রেললাইন থেকে পাথর নিয়ে অতর্কিতে ট্রেনটিতে হামলা চালায়। অনেকে হামলে পড়ে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন বগিতে। বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপের পাশাপাশি চলে ভাঙচুর। ট্রেনের ইঞ্জিনের হেডলাইটসহ কিছু জানালার গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। ঘটনার ভয়াবহতায় মৃত্যু আতঙ্কে ভুগেন ট্রেনটির যাত্রীরা। আর্তচিৎকার ও প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করেন তারা। এ ঘটনায় অন্তত ২০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হলেও আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় তারা কেউই ভৈরবে চিকিৎসা নেননি বলে জানা গেছে। আহত অবস্থাতেই তারা ট্রেনটিতে অবস্থান করেন। তবে আহতদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। 

এ রকম তাণ্ডবের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ১১টা ৪২ মিনিটে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় ঢাকার উদ্দেশ্যে স্টেশন ত্যাগ করে। এদিকে সকাল ১০টায় রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ভৈরব ছাত্র ও যুবসমাজের আহ্বায়ক সাইফুর রহমান শাহরিয়ার, ছাত্রদল নেতা জাহিদুল হক হৃদয়, ছাত্রনেতা শেখ মহিউদ্দিন চিশতি পরাগ, হান্নান হিমুর নেতৃত্বে কর্মসূচিতে যোগ দেন উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুল ইসলাম, পৌর বিএনপি সভাপতি হাজী মো. শাহিন, উপজেলা যুবদল আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন সুজন, জামায়াতে ইসলামী ভৈরব উপজেলা শাখার নায়েবে আমীর অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মুছা, পৌর শাখার সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান মিঠু প্রমুখ।

অবরোধ চলাকালে ভৈরব সার্কেলের এএসপি নয়ন আহমেদ, ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ খন্দকার ফুহাদ রুহানী, স্টেশন মাস্টার মো. ইউসুফ, রেলওয়ে ওসি সাঈদ আহমেদসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে পাথর নিক্ষেপ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

ভৈরব রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ সাঈদ আহমেদ বলেন, রেলপথ অবরোধের কারণে ১০টা ২৫ মিনিটে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনে আটকা পড়ে। ১১টা ৪০ মিনিটে অবরোধ তুলে নেয়ার পর ১১টা ৪২ মিনিটে পুলিশের সহযোগিতায় ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. ইউসুফ বলেন, আন্দোলনের মুখে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনে আটকা পড়ে। গ্রিন সিগন্যাল দেয়ার পরও অবরোধের কারণে ট্রেনটি যেতে পারেনি। আমরা এবং পুলিশ ট্রেনের উপর ও লাইন থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে চাইলে আন্দোলনকারীদের একটা অংশ ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে। ১১টা ৪২ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ভৈরব স্টেশন ছেড়ে যায়। অবরোধের কারণে কয়েকটি ট্রেন পার্শ্ববর্তী স্টেশনে অবস্থান নেয়ায় নির্ধারিত সময়ের ট্রেনগুলো ভৈরব স্টেশনে না আসায় কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় হয়।

এদিকে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনার পর ছাত্র ও যুবসমাজের আহ্বায়ক সাইফুর রহমান শাহরিয়ার তার সহযোগী আন্দোলনকারীদের নিয়ে তাৎক্ষণিক ফেসবুক লাইভে এসে রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. ইউসুফ ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে বক্তব্য রাখেন। রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ও রেলওয়ে কর্মকর্তারাই পাথর নিক্ষেপের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। সাইফুর রহমান শাহরিয়ার বলেন, আন্দোলন বানচাল করতে আন্দোলনকারীদের একটা অংশ ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি। এ ঘটনার দায় আমাদের না।

এ ঘটনার পর সোশ্যাল মাধ্যমে নেটিজেনরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মুনাব্বী হুদা নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেন, “ভৈরব আজকে যা দেখালো, আমি মনে করি সামনে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা  পেছানোর মহাপরিকল্পনা নিয়ে আজকের এই অরাজকতা। যারা পরিকল্পিত এই অরাজকতায় লিপ্ত অবিলম্বে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হোক। লজ্জা থাকা উচিত, যাদেরকে নিয়ে জেলা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কটিয়াদী, নিকলী, বাজিতপুরসহ অন্যান্য উপজেলা আপনাদেরকে মানে না। ছিঃ ছিঃ লজ্জা হওয়া উচিত।” বিমল সরকার নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেন, “ট্রেনে হামলা, ভাঙচুর, পাথর নিক্ষেপ। অরক্ষিত জনজীবন, কোথাও কেউ নেই!!”।