বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়ন মানেই ছিল বিপুল লুটপাট। আর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হতো মন্ত্রী-এমপিদের লুটপাটের সুযোগ করে দিতে। প্রকল্প প্রস্তাবনায় দেখানো হতো প্রকল্পটি গরিবের জন্য একটি মহৎ উদ্যোগ। এতে কর্মসংস্থান হবে, গরিব মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচবে।
কিন্তু পেছনে থাকত মন্ত্রী-এমপিদের লুটপাটের নীলনকশা। এসব প্রকল্পে কোথাও সরাসরি আবার কোথাও কাছের লোকদের সুবিধা দিয়ে লুটপাট করা হতো। এই লুটপাটের ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যাবতীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তেমন একটি প্রকল্প ‘দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ’।
যেসব উপজেলায় দুগ্ধ ঘাটতি রয়েছে সেসব উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর লুটপাটের পরিকল্পনায় যতি টানা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে দেশের দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলাগুলোয় উন্নত সংকর জাতের গাভি পালনের মাধ্যমে দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সমবায় অধিদপ্তর প্রকল্পটি হাতে নেয়। এর মাধ্যমে দেশের ৩৮টি জেলার ৫০টি দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় বছরে গড়ে সাড়ে চার লাখ লিটার দুগ্ধ উৎপাদন বাড়িয়ে পাঁচ হাজার উপকারভোগীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
তবে প্রকল্পটি থেকে লুটপাটের পরিকল্পনা আঁটেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সাবেক সচিব কামালউদ্দিন তালুকদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রকল্পটি থেকে লুটপাট করতে তাঁরা সুবিধা দেন প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের।
প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের মূল ব্যয়ের ১০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল দুগ্ধ ঘাটতি এলাকায় গরু পালনে আগ্রহী পাঁচ হাজার গোয়ালার মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ। ২৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় পাঁচটি হেইফার সেন্টার (গরুর খামার) নির্মাণে, সাড়ে সাত কোটি টাকা ধরা হয় ৩০০ গাভি ক্রয়ে আর গাভির খাবার ক্রয়ে ধরা হয় পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বাকি টাকা অন্যান্য খাতে ধরা হয়।
প্রকল্পে গোয়ালাদের গাভি কিনতে বরাদ্দের ১০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হলেও পাঁচটি হেইফার সেন্টার নির্মাণের ২৪ কোটি টাকা মন্ত্রী-সচিবদের জন্য অনুদান হিসেবে রাখা হয়, যা ফেরত দিতে হবে না। একইভাবে হেইফার সেন্টারের ৩০০ গাভি ক্রয় ও গাভির খাবারের টাকাও মন্ত্রী-সচিবদের অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। মূলত বরাদ্দের এই টাকা লুটপাটের পরিকল্পনা থেকেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়।
পাঁচটি হেইফার সেন্টারের একটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের নিজের এলাকা যশোরের মনিরামপুরে। সেন্টারটি দেওয়া হয়েছিল তারই কাছের লোককে। আরেকটি বাগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন সাবেক সমবায় সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার। শরিয়তপুরের ভেদরগঞ্জে তারই নিকটাত্মীয়কে সেটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আরেকটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সমবায় অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তা গালিব খানের এলাকা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় তাঁর আত্মীয়কে। চতুর্থটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হারুনুর রশিদের এলাকা বরিশালের মুলাদিতে তাঁর কাছের লোককে। পঞ্চমটি বরাদ্দ দেওয়া হয় মানিকগঞ্জের সদর উপজেলায় মিল্ক ভিটার সাবেক এক পরিচালককে। একটি হেইফার সেন্টার পাওয়া মানে সাড়ে সাত কোটি টাকা নিজের ঘরে তুলে নেওয়া। তবে বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এই পাঁচটি হেইফার সেন্টার বাদ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বাদ যাচ্ছে হেইফার সেন্টারের জন্য বরাদ্দ ৩০০ গাভি কেনা ও গাভির খাবারের জন্য রাখা বরাদ্দ।
প্রকল্পটি লুটপাটের মহোৎসব ছিল উল্লেখ করে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পে লুটপাট করা যায়—এমন কোনো অঙ্গ রাখতে দেওয়া হবে না। হেইফার সেন্টারগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব উপজেলা এই প্রকল্পের জন্য অপ্রয়োজনীয় ছিল সেগুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে।’
এ ছাড়া প্রকল্পটি থেকে বাদ যাচ্ছে দুগ্ধ ঘাটতি না থাকা এবং হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সাত জেলার ১২ উপজেলা। এর মধ্যে রয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সাবেক সচিব কামালউদ্দিন তালুকদারের শরিয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, সমবায় অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তা গালিব খানের এলাকা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা, প্রকল্প অনুমোদন পেতে যুক্ত করা সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ, সাবেক রাষ্ট্রপতির এলাকা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের এলাকা কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমদের ময়মনসিংহের তারাগঞ্জ, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, রাজশাহীর তানোর, রাজবাড়ীর কালুখালী, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী এবং খুলনার পাইকগাছা।
এসব উপজেলা বাদ দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, এই উপজেলাগুলো দুগ্ধ ঘাটতিপূর্ণ ও ফ্রিজিয়ান গাভি পালনের উপযোগী এলাকা নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এগুলো নেওয়া হয়েছে। আর গাভি দেওয়ার জন্য যাদের তালিকা দেওয়া হয়েছিল তাদের আসলেই গাভি পালনের আগ্রহ নেই। গাভি পালনের পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই তাদের।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুগ্ধ ঘাটতিপূর্ণ এলাকা না হওয়ায় প্রকল্প থেকে কয়েকটি উপজেলা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কয়েকটি জেলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূল প্রকল্পে হেইফার সেন্টারগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়ায় সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।’
এমন লুটপাটের পরিকল্পনার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে এমনটাই হয়েছে। তাই সব প্রকল্প পুনরায় মূল্যায়ন করা উচিত। যারা এসব লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা যায়, প্রতি উপজেলায় বছরে গড়ে চার লাখ ৫০ হাজার লিটার দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। যার মাধ্যমে পাঁচ হাজার উপকারভোগীর কর্মসংস্থান এবং দুই হাজার নারীর অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কথা বলা হয়।
জানা গেছে, ১৫৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২২-এর জুলাই থেকে ২০২৬-এর জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল একনেক সভায় অনুমোদিত হয়।
গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বা ২৫.৮১ শতাংশ।