Image description

বাংলাদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান—এই চারটি দেশের মধ্যে সৌদি ছাড়া অন্য তিনটি দেশে কর্মী পাঠানো সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরেরও বেশি সময়ে এই বাজারগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সৌদির শ্রমবাজারেও চলছে নানা জটিলতা। এর ফলে বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার দিন দিন কমছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মী গেছেন আট লাখ ১৩ হাজার ৬৪ জন, যা জনশক্তি রপ্তানি খাতে রেকর্ড করা ২০২২ ও ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ৭.৫ শতাংশ ও ১৭.৮৫ শতাংশ কম। ওই দুই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যথাক্রমে আট লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৯ জন ও ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ জন কর্মী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের চেয়ে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬.৩৯ শতাংশ কর্মী বেশি গেছেন। গত বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ছয় লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৮ জন কর্মী।

অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। ভরসার বাজার হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবেও তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। অবৈধ অভিবাসন, মানবপাচার, আইন লঙ্ঘন ও দক্ষ কর্মীর অভাবে কমছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান। আবার বিভিন্ন বিধি-নিষেধ, ভিসা বন্ধসহ নানা কারণে গত বছর পর্যন্ত বন্ধ হওয়া ৯টি শ্রমবাজারের একটিও এ পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি।

এর ফলে প্রতিনিয়তই কমছে বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার। এতে জনশক্তি রপ্তানি খাতে ধস নামার আশঙ্কা দেখছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।

তাঁদের মতে, দ্রুত সময়ের মধ্যে শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণা করে নতুন বাজার চালু এবং পুরনো বাজার খুলতে না পারলে ক্ষতির মুখে পড়বে খাতটি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা।

জনশক্তি রপ্তানি খাতের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমবাজার নিয়ে ভালো কিছু করবে।

প্রধান উপদেষ্টা নতুন শ্রমবাজার চালু এবং বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই জায়গাগুলোতে দৃশ্যমান কিছু হয়নি।

তিনি আরো বলেন, শ্রমবাজারকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডেডিকেটেড লোক দিয়ে শ্রমবাজারগুলো নিয়ে গবেষণা করাতে হবে। কোথায় কোথায় নতুন বাজার খোলা যাবে এবং পুরনো বাজারগুলো কিভাবে খোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণা জরুরি। একই সঙ্গে বন্ধ থাকা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে ওই দেশগুলোর শ্রমবাজার আবারও উন্মুক্ত করা প্রয়োজন। এখানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ জরুরি।

ভরসার বাজার সৌদিতেও নানা জটিলতা

সৌদি আরব বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় এবং ভরসার শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর মূল জনশক্তির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কর্মী সৌদি আরবে যান। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে আট লাখ ১৩ হাজার ৬৪ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, এর মধ্যে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৫৯৭ জন কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। অর্থাৎ মূল জনশক্তির ৬৭.৭ শতাংশ কর্মী গেছেন সৌদি আরবে।

তবে সৌদি আরবে এখনো বেশিসংখ্যক কর্মী গেলেও সেখানকার বাজারেও নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, এই বাজারে কাজ করতে গেলে কর্মীদের তাকামুল নামে একটি সনদ নিয়ে যেতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাকামুল সনদ হচ্ছে দক্ষতার পরীক্ষায় পাস করা সনদ। শুরুতে সাধারণ কর্মী কিংবা ক্লিনারদের জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে বর্তমানে সব পেশার কর্মীকে এই পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার জন্য কর্মীপ্রতি আলাদা ৫০ ডলার (বর্তমানে ছয় হাজার ১০০ টাকা) ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়া পরীক্ষাটি দিতে কর্মীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টসহ দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতে নানা ধরনের ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন কর্মী ও জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, সব ধরনের কর্মীর জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না করে শুধু যাঁরা দক্ষ কর্মী রয়েছেন তাঁদের জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি পুরোপুরি সৌদি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত; এ বিষয়ে তাঁদের করার কিছু নেই।

তাকামুল সনদের পরীক্ষা ছাড়াও দেশটিতে যাওয়ার পর আকামা, চাকরি, বেতনসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কর্মীরা। এতে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটে তাঁদের।

গত বছর পর্যন্ত বন্ধ হওয়া একটি বাজারও এখনো চালু হয়নি

বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমানসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি শ্রমবাজার গত সরকারের আমলেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত একটি শ্রমবাজারও চালু করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হলেও বাজার দুটি চালু করা সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ চালু হবে তা-ও নিশ্চিত করা যায়নি। আবার দূতাবাস না থাকায় ইউরোপের শ্রমবাজারের সমস্যাও সহজে কাটছে না বলে জানিয়েছেন অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জাপান সেলেও আসেনি সক্ষমতা

আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সুযোগ কাজে লাগাতে জাপান সেল গঠন করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গত ২০ আগস্ট উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, জাপানে বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে জাপান সেল গঠন করা হয়েছে। আগে তিনটি খাতে দক্ষতার পরীক্ষা থাকলেও এখন তা পাঁচটি খাতে উন্নীত করা হয়েছে। জাপানের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও সনদ দেওয়ার জন্য পৃথক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

তবে বিএমইটির তথ্য বলছে, গত ৯ মাসে মাত্র ৯৬২ জন কর্মী জাপানে গেছেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জাপানে একজন কর্মীও পাঠাতে পারেনি ৬২ রিক্রুটিং এজেন্সি। এর ফলে গত ৩১ আগস্ট এই এজেন্সিগুলোর কাছে কর্মী পাঠাতে না পারার ব্যাখ্যা চেয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাছিনা বেগম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীরা রয়েছেন ধোঁয়াশায়

গত বছর মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৭ হাজার কর্মীর মধ্যে প্রথম ধাপে প্রায় আট হাজার জনকে নিতে বাছাই করেছে দেশটি। তবে নির্ধারিত সময় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁদের পাঠানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ নিয়োগদাতা থেকে এখনো কোনো চাহিদাপত্র পাঠানো হয়নি।

মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করা সাত হাজার ৮৬৯ জনকে নির্মাণ ও পর্যটন খাতে নেওয়া হবে। তাঁরা যাবেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে।

বোয়েসেল সূত্র জানায়, কর্মীদের পাঠানোর প্রক্রিয়া তারা এরই মধ্যে শুরু করেছে। সবাইকে মোবাইল ফোনে বার্তা দেওয়া ও কল করা হয়েছে। আগ্রহীদের পাসপোর্টের কপি ও মালয়েশিয়ার নির্মাণশিল্প উন্নয়ন বোর্ডের (সিআইডিবি) নির্ধারিত আবেদন ফরম পূরণ করে বোয়েসেলে ই-মেইল করতে বলা হয়েছে। সিআইডিবির প্রশিক্ষণ ও সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর মালয়েশিয়া যেতে কর্মী চূড়ান্ত করা হবে।

তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চাহিদাপত্র আনা, প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সাক্ষাৎকার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ফ্লাইটসহ নানা প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।