রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) কী কোনোদিনও দুর্নীতিমুক্ত হবে না? এই প্রশ্ন আমলে ঘুরে ফিরে সামনে এসেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও হাসিনার দোসররা বিআরটিসির উচ্চপদে আসীন থাকার কারণে দুর্নীতি রোধ করা তো দূরের কথা, বিআরটিসি জায়গা ও বাস লিজ নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের উল্টো পুনর্বাসন করে চলেছেন।
আওয়ামী লীগের আমলে শাজাহান খানকে সাথে নিয়ে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। সারাদেশে তার মালিকানাধীন শত শত বাস আছে। সেই সব বাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১১৯টি বাস জব্দ করে বিআরটিসির কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দেয়।
কিন্তু বিআরটিসির কর্মকর্তারা সেই সব বাস নিতে রাজি হননি। এর নেপথ্যেও রয়েছে এনায়েত উল্লাহ ও শাজাহান খানের হাত। তারা বিআরটিসির কর্মকর্তাদের লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছেন। এই সুযোগে বিএনপি নাম ভাঙিয়ে জামাল-কামাল নামে দুই সহোদর বিআরটিসির পক্ষে এনায়েতের মালিকানাধীন এনা পরিবহনের বাস চালিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। অথচ বিআরটিসি ইচ্ছা করলে এনায়েত উল্লাহর বাস এনা পরিবহন ভাড়া দিয়ে হলেও সরকারের রাজস্বখাতে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা দিতে পারতেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে বিআরটিসি মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। সরকারের কাছে তাদের যেন কোনো দায় নেই। নিজের পকেট ভারী হলেই চলবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, এনা পরিবহনের বাস বিআরটিসি কেনো নিচ্ছে না-তা চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করেন। উনি ইচ্ছা করে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করছেন। এই সুযোগে জামাল-কামাল কোটিপতি হচ্ছে। আমাদের পরিবহন ব্যবসার ক্ষতি করছে।
জানা গেছে, হাসিনার আমলে ২০১৩ সালে ৫০টি ‘আর্টিকুলেটেড’ বাস কিনেছিল বিআরটিসি। বলা হয়েছিল, ভারতীয় ঋণের আওতায় কেনা এ বাসগুলো ঢাকার গণপরিবহনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মধ্যেই ৪৩টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে, যা অনেককে মনে করিয়ে দিতে পারে আড়াই দশক আগে সুইডেন থেকে কেনা বিশ্বখ্যাত ভলভো বাসের অভিজ্ঞতার কথা।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি অযতœ-অবহেলা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিতে জেঁকে বসে থাকা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি দিক মাত্র। গত কয়েক বছর আগের অনিয়ম-দুর্নীতির জের বিআরটিসি এখনো টেনে চলেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে বিআরটিসির মূল লক্ষ্য যাত্রীসেবা। প্রচলিত বাসের প্রায় দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যরে ‘আর্টিকুলেটেড’ বাসের কাঠামোর জন্য বিদেশে জনসাধারণের কাছে বেন্ডি, স্ট্রেচ, সিøংকি ইত্যাদি নামে পরিচিত। বৈধ দৈর্ঘ্যের মধ্যে থেকে এই বাসে তুলনামূলকভাবে বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হওয়ায় এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তুলনামূলক সরু রাস্তায় চালানো কিছুটা সমস্যা হওয়ায় অবশ্য বিশ্বের অনেক শহর থেকে দুটি অংশ জুড়ে তৈরি করা এ বাস তুলে দেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে কেনা ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মধ্যে বিআরটিসি ২০২২ সালে ২৭টি আবার চালু করে। বাকি বাসগুলো এখনো ডিপোতে পড়ে রয়েছে। এসব নিয়ে গত ১৫ বছরে সংস্থাটির বহরে যুক্ত হয়েছে মোট ১ হাজার ৫৫৮টি বাস। এর মধ্যে কাগজে-কলমেই চালু আছে ১ হাজার ২৪৪টি। আর চারটি প্রকল্পে এসব বাস কেনায় খরচ হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। এ সময়ে অনেক বাস নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় কিছু ‘ভাঙারি’ হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা সময়মতো মেরামত না করায় গাড়ি অচল পড়ে থাকায় যাত্রীসেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিআরটিসির আয়ে প্রভাব পড়েছে। দায়দেনা শোধে অসুবিধা ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত সংস্থাটি। অথচ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা, পরিচালক (প্রশাসন ও অপারেশন) রাহেনুল ইসলাম, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম গোলাম ফারুক দিব্যি উপরি আয়ের টাকায় ফুলে-ফুঁপে উঠেছেন। তারা নতুন করে কাউকে আর লিজ দিতে চান না। নতুন কেউ লিজ চাইলেই তাদের আয়ের প্রধান উৎস ফ্যাসিস্ট দোসরদের ব্যবসায় টান পড়ে বলে তারা আইনের দোহাই দিয়ে থাকেন। অথচ স্বৈরাচারের পক্ষে আইন দেখাতে তাদের এতটুকু লজ্জা করে না। যে কারণে এখনও হাসিনার এপিএস লিকুর ‘টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেস’ বাস চলছে। এর নেপথ্যে ব্যবসা করছেন বিআরটিসির ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম গোলাম ফারুক। এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বিআরটিসি এখনও আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। আমাদেরকে কোনোভাবে সহযোগিতা করা তো দূরে থাক একটুও সহানুভূতি দেখায় না। যে কারণে বিএনপির সমর্থক পরিবহন ব্যবসায়ীরা আর বিআরটিসির কথা ভাবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিআরটিসি এখন সবগুলো বাস চালায় ভাড়ার চুক্তিতে। শুধুমাত্র চালক ও জ্বালানী তাদের নিজস্ব। চুক্তিতে এক ট্রিপে ২ হাজার টাকা ধরা থাকলে বাস্তবে তারা আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে থাকে। রুটভেদে এই ভাড়ার তারতম্য আছে। সাথে জ্বালানী চুরির হিসাব তো আছেই। এতে করে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২/৩ লাখ টাকা উপরি যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। এই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় সপ্তাহের শেষের দিন বৃহস্পতিবারে। বিআরটিসির ব্যবসা যারা করেন তাদের কাছে এগুলো ওপেন সিক্রেট। জানা গেছে, বিএনপির এক নেতা কমফোর্ট পরিবহনের বাসের জন্য বিআরটিসির কাউন্টার ও জায়গা লিজ চাইলে তাকেও আইনের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। যার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম গোলাম ফারুক নিজেই। তিনি বলেছেন, কমফোর্টকে লিজ দিতে হলে হাসিনার এপিএস লিকুর জায়গা বরাদ্দ দিতে হবে। এজন্য নাকি অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। টুঙ্গীপাড়া থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগবে। পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, গোলাম ফারুকের ঔদ্ধ্যত দেখে আমি অবাক। আমরা চাই যে করেই হোক ফ্যাসিস্ট হাসিনার এপিএস লিকুর টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেসের লিজ বাতিল করতে হবে। তা না হলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোরালো আন্দোলন করবো। প্রয়োজনে বিআরটিসি ভবন ঘেরাও করবো।