*** একটি কোর্ট মার্শালের প্রসিকিউটর হওয়ার অভিজ্ঞতা: পর্ব:১
একদা আমার বড় চাচা মরহুম আব্দুল আজিজ তালুকদার ছিলেন নেত্রকোনা শহরের পয়লা নম্বর ক্রিমিনাল লইয়ার। তার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, তার সাদাসিধা জীবনাচরণ এবং আইন পেশায় তার দক্ষতা কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বড় চাচাকে এবং আইন পেশাটা আমার কাছে খুব স্মার্ট মনে হলেও আমি নিজে কখনো আইন পেশায় আসার কথা ভাবিনি।
সে যা'ই হোক, আজ জানাবো আমার সেনাবাহিনীর চাকুরী জীবনে একবার ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের প্রসিকিউটর হওয়ার অভিজ্ঞতা।
আমি তখন সিলেট সেনানিবাসে একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ানের (রিয়ার) অধিনায়ক। ব্যাটালিয়ানের মূল দল তখন ইউএন মিশনে। তখন ছিল জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এবং জনাব ফখরুদ্দিনের সরকার। তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত মিস্টার আনোয়ার চৌধুরী সেনাপ্রধানকে কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়ে বললেন, দুইজন লন্ডন প্রবাসী সিলেটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সিলেট সেনানিবাসের মেজর এক্স (সংগতকারণে আমি এখানে উক্ত অফিসারের নাম উল্লেখ করছি না। তিনি তার অপরাধের শাস্তি পেয়েছেন ইতোমধ্যে এবং বর্তমানে শুদ্ধ জীবন যাপন করছেন)। ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বিপুল অংকের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগ পাওয়ার পর আমার তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার আমাকে একদিন ডেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্রিফিং করলেন। স্যারের বক্তব্য হচ্ছে, মেজর এক্স একজন সৎ অফিসার সে কঠোর ভাবে তার দায়িত্ব পালন করছেন তাই স্থানীয় লোকজন তার পিছনে লেগেছে। ঘটনার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য হয়ত তারা মিস্টার আনোয়ার চৌধুরীকে ব্যবহার করেছে। তুমি যেহেতু দীর্ঘদিন গোয়েন্দা সংস্থায় চাকুরী করেছ তাই তদন্ত কাজে তোমার অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে তোমাকে এই দায়িত্ব দেয়া হল। তদন্ত আদালতের সভাপতি মেডিক্যাল কোরের লেঃ কর্নেল পদবীর একজন অফিসার তাই তোমাকেই হয়ত মূল কাজটা করতে হবে। তোমার সাথে থাকবে এসআইএন্ডটি থেকে নিযুক্ত আরেকজন মেজর। এরপর স্যার মিস্টার আনোয়ার চৌধুরী যে সব দলিল দস্তাবেজ, ফোন/ভিডিও রেকর্ডিং দিয়েছিলেন তা আমাকে হস্তান্তর করেন। আমি কমান্ডারকে নিশ্চয়তা প্রদান করি এই বলে যে, স্যার ইনশাআল্লাহ আমি সত্য বের করে আনবো এবং মেজর এক্স নির্দোষ হলে তদন্তে নিরাপরাধ বিবেচিত হবেন।
পরবর্তীতে এসআইএন্ডটি থেকে একজন কমান্ডো অফিসার(তাকে মেজর ওয়াই নামে ডাকবো) যে কিনা মেজর এক্স এর কোর্সমেট তাকে নিযুক্ত করা হল। তখন ব্রিগেড কমান্ডার আমাকে বললেন, এই অফিসার তো মেজর এক্সের কোর্সমেট এটা তো সমস্যা হবে তোমার জন্য। আমি স্যারকে বললাম, স্যার মেজর ওয়াইকে আমি ভালভাবে চিনি; আপনি যদি সেই অফিসারের পিতার বিরুদ্ধেও কোন তদন্তে নিয়োগ করেন তবেও সে সত্যের একচুল পরিমাণ ব্যত্যয় করবেনা। আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি। স্যার বললেন তুমি রাজী থাকলে আমার কোন সমস্যা নাই।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, উল্লেখিত সেই কমান্ডো অফিসার ছিল পেশাগত ও নৈতিকতায় একজন প্রথমশ্রেণীর অফিসার, সেনাবাহিনীর এ্যাসেট। যদিও ব্যক্তিগত কারণে নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই সে অবসরে চলে গেছে।
দায়িত্ব পেয়েই আমি এসআইএন্ডটির স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইংএ সেই মেজর ওয়াই এর সাথে সমন্বয় করতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মেজর এক্স তার সাথে বসে আছে। মেজর এক্স এর সাথে আমি উভয়েই সেকেন্ড লেঃ/লেঃ পদে একটি গ্যারিসনে চাকুরী করেছি। দুইজনের মধ্যে একটি সহজ, বন্ধু বৎসল রেস্পেক্টেবল সম্পর্ক বরাবরই ছিল। সে আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বললো, স্যার বিষয়টা একটু দেখবেন প্লিজ। আমি তাকে বললাম যে, ইনশাআল্লাহ তুমি যদি নির্দোষ হও তবে তোমাকে আমরা বের করে নিয়ে আসবো। চিন্তা করো না। এরপর মেজর ওয়াই এর সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় শেষে আমি চলে আসলাম। কথা হল আমি সেদিন রাতেই সব এভিডেন্স দেখে তার পর আমি সভাপতি সহ একসাথে বসে তদন্তের পথ ঠিক করবো।
আমি অফিস থেকে ফিরেই এভিডেন্স দেখা শুরু করলাম। কিছু ফোন কল রেকর্ড আর ভিডিও ক্লিপ দেখে আর তাদের স্টোরিটা পড়ে আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যে খানিকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে মেজর এক্স এবং তার লন্ডন প্রবাসী ভাই দুইজনে মিলে এই অপকর্মটি করেছে। যদিও এ সব এভিডেন্স দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তারা দুই ভাই মিলেই এটা করেছে তবুও এটা কোর্টে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করতে আমাকে আরও তদন্ত করতে হবে এবং প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। ডিনারের আগে মেজর ওয়াই কে ফোন দিয়ে বললাম, আজ বাসায় খিচুরী আর গরুর মাংস হচ্ছে ডিনারে। তুমি দ্রুত চলে আসো। উল্লেখ্য যে, মেজর ওয়াই তখন অফিসারস্ মেসে থাকতো। মেজর ওয়াই আমার বাসায় আসার পর তাকে কিছু আলামত দেখিয়ে বললাম, তোমার বন্ধু কাজটা করেছে নিশ্চিত। তোমার কি মনে হয় বলো? ওয়াই বললো, স্যার আমিও মোটামুটি নিশ্চিত সে এই কাজ করেছে। আমি আর মেজর ওয়াই দু'জন মিলে ডিসিশন নিলাম তদন্ত আদালতের সভাপতির সাথে সকালে কথা বলে আমরা মেজর এক্স কে একটা সুযোগ দেবো। এক্স যদি তার দোষ স্বীকার করে তবে আমাদের কাজটা সহজ হবে এবং দোষ স্বীকার করলে তার শাস্তিটা লঘু হবার সম্ভাবনা থাকবে।
পরদিন সকালে আমি আর মেজর ওয়াই মিলে তদন্ত আদালতের সভাপতির কাছে গেলাম এবং আমাদের পরিকল্পনা বললাম। তিনি বললেন আমরা তাহলে আইনের ব্যত্যয় করব। সে যদি দোষ স্বীকার না করে তবে তাকে আমরা অযথাই তার বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখিয়ে দিব এবং সে এ বিষয়ে ডিফেন্স প্রস্তুত করবে। আমি আবার স্যারকে বুঝিয়ে বললাম, ‘স্যার আমাদের এমনিতেই তার সাক্ষ্য নেবার সময় এসব অডিও/ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে তাই আগে দেখালেও কোন সমস্যা হবে না আশাকরি। স্যার তারপরও তাকে দোষ স্বীকার করার সুযোগ দিতে রাজী হলেন না। পরবর্তীতে আমি আর মেজর ওয়াই ডিসিশন নিলাম সভাপতির অজান্তেই মেজর এক্সকে একটা সুযোগ দিব দোষ স্বীকার করার। এর মাধ্যমে আমরা মূলত মেজর এক্সকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।
এরপর আমরা ফিল্ড এ্যাম্বুল্যান্সের (তদন্ত আদালতের সভাপতির ইউনিট) অফিসারস্ মেসে মেজর এক্সকে ডাকলাম। তাকে কিছু প্রমাণাদি দেখালাম এবং শুনালাম। তাকে বুঝিয়ে বললাম এই অডিও/ভিডিওর সাথে ভিক্টিম এবং তার পরিবার যখন এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে তখন তা তদন্ত আদালতে এবং পরে যদি ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল হয় তবে তুমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে না। আর তুমি যদি আগেই দোষ স্বীকার করে ফেল তবে তুমি জিওসির সিমপ্যাথি পেতে পারো এবং তোমার লঘু শাস্তি হবে। মেজর এক্স প্রথমে অডিও/ভিডিওগুলো বানোয়াট বলার চেষ্টা করলো। তারপর তার ভাই লন্ডনে হয়ত তার নাম ভাংগিয়ে এই চাঁদাবাজী করেছে যার সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই; তা বলার চেষ্টা করলো। এরপর আমরা তাকে একজন ভিক্টিমের সাথে তার টেলিফোন কনভারসেশন শুনানোর পর সে বলার চেষ্টা করলো যে এটা তার কন্ঠস্বর নয়। আমি তাকে বুঝালাম এটা তোমার কন্ঠস্বর কিনা সেটা কোর্ট নির্ধারণ করবে। যাহোক এটা এখন তোমার ডিসিশন তুমি দোষ স্বীকার করবে কিনা।
মেজর এক্স অবশেষে নিজের দোষ স্বীকার করলো। আমরা তখন তাকে বললাম, তুমি এখন তোমার একটি স্টেটমেন্টের মাধ্যমে এই তদন্ত আদালতের সমাপ্তি করতে পার। তুমি নিশ্চিত থাক যে, আমরা তোমাকে লঘু দন্ড দেবার সুপারিশ করবো। মেজর এক্স বলল যে, সে রাতে তার জবানবন্দী লিখে সকালে জমা দিবে। আমরা তার প্রস্তাবে রাজী হলাম। উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত আমরা সভাপতিকে কিছু অবহিত করিনি। কিন্তু হায়! পরদিন সকাল থেকে মেজর এক্সের কোন খোঁজ নাই।
কোথায় গেলো আমাদের মেজর এক্স?
চলবে।
***একটি কোর্ট মার্শালের প্রসিকিউটর হওয়ার অভিজ্ঞতা: পর্ব: ২
পরদিন সকাল থেকে আমি এবং মেজর ওয়াই অপেক্ষা করছিলাম কখন মেজর এক্স তার স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি নিয়ে হাজির হবে! দুপুর ১২টার দিকে যখন তার কোন খোঁজ পেলামনা তখন তার অফিসার মেসের রুমে সিএমএইচ এবং তার ইউনিটে খোঁজ নিলাম; না সে কোথাও নেই। তার অধিনায়কের কাছে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম তিনি তাকে ছুটি দিয়েছেন কিনা? তিনি না বললেন। আরও বললেন মেজর এক্স যদি আজ অফিস আওয়ারের মধ্যে না আসে তবে তিনি এবসেন্ট রিপোর্ট(AWOL) পাঠিয়ে দেবেন। তবে শেষ পর্যন্ত মেজর ওয়াই আমাকে দুটো বাজার আগেই ফোন করলো, আমি তাকে আমার অফিসে আসতে বললাম। সে কিছুক্ষণ পর আসলো, তার জন্য কফির অর্ডার করলাম ফিল্ড মেসে। জিজ্ঞেস করলাম
-তোমার স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি লিখেছো?
-স্যার কীসের স্বীকারোক্তি?
বুঝলাম জনাব এক্স তার মত পরিবর্তন করেছেন! নিশ্চয়ই কেউ তাকে কু-বুদ্ধি দিয়েছে। তাকে বুঝিয়েছে যে এই স্বাক্ষী প্রমান শেষ পর্যন্ত কোর্ট মার্শালে প্রমান করা দূরুহ হবে তাছাড়া স্বাক্ষীরা থাকে লন্ডনে এটা কোর্ডিনেট করে কোর্ট মার্শালে প্রমাণ করা সহজ হবেনা। যাহোক আমি চ্যালেন্জটা নিলাম। মেজর এক্সের সাথে এখন থেকে যা হবে তা হল প্রফেশনাল ডিলিংস।
আমি এবং মেজর ইমতিয়াজ(আগের পর্বে যাকে মেজর ওয়াই বলেছিলাম) মোটামুটি লেঃ কর্নেল গালিব স্যারের (তদন্ত আদালতের প্রেশিডেন্ট)কাছে একটু ব্যাক ফুটিং এ পরে গেলাম। সিনিয়র হিসেবে তার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের তিনি সঠিক এ্যাডভাইস দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে স্যারের আদেশের ব্যাত্যয় করেছি। যাহোক আমি আর ইমতিয়াজ মিলে এর প্রথমিক পরিকল্পনা করলাম।আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন-এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে:
“Give me six hours to chop down a tree and I will spend the first four sharpening the axe.”
এই কথাটির মূল ভাব হলো—কোনো কাজ শুরু করার আগে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তুতি যত ভালো হবে, কাজ তত সহজ ও কার্যকর হবে।
মেজর এক্সকে অফিসিয়ালি জিজ্ঞেসাবাদ শুরুর আগে আমি যত অডিও ভিডিও আছে তার বাংলা ট্রান্সক্রিপ করলাম। আসলে বাংলা ট্রান্সক্রিপ না বলে সিলেটি ট্রান্সক্রিপ বলা ভাল। ৯০% কথাবার্তাই ছিল সিলেটি ভাষায়। আমি যেহেতু সিলেট ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে সিলেটের এইডেড স্কুলে পড়াশোনা করেছি তাই আমার সিলেটি ভাষা মন্দ ছিলনা। এমনকি আমার বেগম সাহেবা (তিনি হবিগঞ্জের) থেকে ভাল সিলেটি বলতাম একসময়। এর সাথে আমার গোয়েন্দা কানেকশন ব্যাবহার করে মেজর এক্সের গত দেড় বছরের ফোন রেকর্ড এনেছিলাম গ্রামীণ ফোন থেকে।এরপর শুরু হলো বিভিন্ন তথ্যের লিংকআপ এবং মেজর এক্সের জন্য ড্রাফট প্রশ্ন এবং সম্ভাব্য সম্পুরক প্রশ্ন তৈরী।
সেনাবাহিনীতে সাধারণত দেখা যায় এমন তদন্ত আদালতের সাথে জুনিয়র মোস্ট অফিসার জরিত থাকে আর বাকিরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়। ইউনিটে বলে আসে তদন্ত আদালতে আছি কিন্তু অনগ্রাউন্ডে এখানে একবার চেহারা দেখিয়ে অন্যান্য কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তবে কিছু কঠোর তদন্ত আদালতের প্রেসিডেন্টকে দেখেছি তিনি সব মেম্বারকে কোন কাজ করুক আর না করুক আদালতে হাজির রাখেন। সেই হিসেবে মেজর ইমতিয়াজের বেশীরভাগ কাজ করার কথা কিন্তু আমি জানি মেজর ইমতিয়াজ একজন ডেডিকেটেড কমান্ডো প্রশিক্ষক সে কখনোই তদন্ত আদালতের নামে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেনা তাই তাকে আমি তার কাজ চালিয়ে যেতে দিলাম। একই ভাবে লেঃ কর্নেল গালিব স্যার আমাকে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। তবে মেজর ইমতিয়াজের কমান্ডো প্রশিক্ষক হিসেবে ডেডিকেশন আউটলেট্যান্ডিং লেভেলের। সে স্কাই ডাইভিং কোর্সে আমার প্রশিক্ষক ছিল; আমাদের বেশ কিছু সুইট এন্ড সাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে
তবে আমরা বরাবরই ছিলাম ভেরী গুড ফ্রেন্ড।
আবার আসি তদন্ত আদালত প্রসঙ্গে। আমি মেজর এক্সের সম্ভাবত দেড় বছরের ফোন রেকর্ড এনেছিলাম। হঠাৎ মনে হল দেখিতো যেদিন আমরা মেজর এক্সকে কিছু প্রমাণ দেখিয়ে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিতে রাজি করিয়েছিলাম সেদিন সে কার কার সাথে ফোনে কথা বলেছে? দেখলাম সেদিন রাতে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২ টার মধ্যে সে মোট ১৫/১৬ বার একটি নং এ বেশ লম্বা সময় ধরে কথা বলেছে। আমি ভাবলাম সেনাবাহিনীর কোন আইন বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ কারও কাছে পরামর্শ করেছে। আমি ফোন নং টি আমার ফোনে টাইপ করতেই দেখলাম এটা BM SARWAR নামে আমার ফোনে সেইভ করা আছে। কৌতূহলের অবসান হলো। আমি সিলেট পোস্টিং আসার পূর্বে ৬৫ পদাতিক ব্রিগেড কাপ্তাই এ জিএসও-২ ইন্টেলিজেন্স হিসেবে কাজ করেছি আর সেখানে ব্রিগেড মেজর বা বিএম ছিল তৎকালীন মেজর সারোয়ার।
জী তিনি বর্তমানে মেজর জেনারেল সরোয়ার ; গুম খুনের অপরাধে বিশেষ সাবজেলে গ্রেফতার আছেন। সারোয়ারের ছেলে আর আমার ছেলে তখন কাপ্তাইতে একই ক্লাসে পড়তো। খবরটা শুনে সে খুব মন খারাপ করেছে।
সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত।
চলবে।
***একটি কোর্ট মার্শালের প্রসিকিউটর হওয়ার অভিজ্ঞতা: পর্ব: ৩
মেজর এক্স এর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল তিনি দুইজন লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছেন। তখন ছিল ১/১১ এর সরকার এবং মেজর এক্স এর ইউনিট সিলেট সদরে মোতায়েন আছে; সেই সুযোগে মেজর এক্স সিলেটের দুটি আবাসিক হোটেলে হানা দিয়ে তাদের লন্ডনের মালিকের ঠিকানা এবং ফোন নং সংগ্রহ করে। তারপর মেজর এক্স তার লন্ডন প্রবাসী ভাইকে সেই পরিবারের কাছে পাঠিয়ে চাঁদা দাবি করে অন্যথায় তাদের পারিবারিক হোটেল ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
দায়িত্ব পেয়ে আমরা তদন্ত শুরু করলাম সিলেটের সেই দুটি আবাসিক হোটেল পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে। সেখান থেকে দুই মালিকের বাসায়। তাদের যে কয়জন কর্মচারী এবং আত্মীয়স্বজন এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হল। সেখান থেকে এসে লন্ডনে একজন মালিকের ছেলে রাজ সাত্তারের সাথে কথা হল। রাজের বয়স ২৪/২৫ হবে। তাকে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনেহলো। তার কাছ থেকে আমি অনেক তথ্য এবং সূত্র পেলাম।
লন্ডনে মেজর এক্সের ভাই তাদের বাসায় এসে যা বলেছে তা ভিডিও করে রেখেছিল ওরা যা ব্রিটিশ এ্যাম্বাসেডার আনোয়ার চৌধুরীর মাধ্যমে আমাকে দিয়েছিল। যেটা আমি জানতাম না তা হল মেজর এক্সের ভাইকে তারা ইতোমধ্যেই পুলিশে সোপর্দ করেছে। রাজ আরও বলল যে, পুলিশ তদন্তে পেয়েছে তার ভিসা সন্দেহজনক কারণ সে ভিসা পেয়েছে আইভরি কোস্ট ব্রিটিশ এ্যাম্বাসি থেকে কিন্তু সে কখনো আইভরি কোস্ট ভ্রমণ করেনি। বুঝতে পারলাম যে, এই চক্রের গোড়ায় গলদ আছে তবে রাজ সাত্তারকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
আমি এবং মেজর এক্স একই সাথে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আইভরি কোস্টে মোতায়েন ছিলাম তবে দুটি ভিন্ন ব্যাটালিয়ানে। তার সাথে আইভরি কোস্টে অনেকবার আবিদজানে দেখা হয়েছে আমার। ঘটনা হচ্ছে ইউএন পিস কিপার হিসাবে আমরা একটি কভারিং লেটার দিয়ে আমাদের পাসপোর্ট ব্রিটিশ এ্যাম্বাসীতে পাঠিয়ে দিলেই তারা ইউকের ভিসা দিয়ে দিতো। মেজর এক্স তার ভাইয়ের পাসপোর্ট বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়ে ব্যাটলিয়ানের অন্যান্য অফিসারদের পাসপোর্টের সাথে তার ভাইয়ের পাসপোর্টও পাঠিয়ে দিয়েছিল। এবং বলাবাহুল্য কোন প্রকার যাচাই বাছার না ব্যতিরেকেই তার ভিসা হয়েছিল। সেনা আইনে এটি গুরুতর অপরাধ এবং এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবার কথা। মেজর এক্সকে তার ভাইয়ের ইউকে'র ভিসা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন যে, এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক এবং তিনি এই ব্যাপারে কোন কথা বলতে চান না। পরবর্তীতে তাকে ভিসা বিষয়ে আবারও জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, তার ভাই কিভাবে ইউকের ভিসা পেয়েছে তা তিনি অবগত নন।
আনুমানিক এক মাস সময় নিয়ে আমরা তদন্ত কাজ সম্পন্ন করি। এর মধ্যে সিলেট মেডিকেল কলেজের পরিচালক একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করি। তিনি মেজর এক্সের অধিনায়ককে তার অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে আগেই জানিয়েছিলেন। আমরা সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির সাথে কথা বলি। তদন্তের সময় আমার মাথায় ছিল মেজর এক্স এর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজীর মত গুরুতর অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে এটা পরবর্তীতে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের দিকে যাবে এবং তখন হয়ত আমাকেই প্রসিকিউটরের দায়িত্ব দেয়া হবে। এখানে বিবেচনার বিষয় হচ্ছে একটি তদন্ত কমিটি সাক্ষ্যপ্রমাণ সহকারে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে আবার অনেক সময় সারকামস্টেনসিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে ঘটনার বিচার করে মতামত দেওয়া যায়; কিন্তু ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালে সেটা সম্ভব নয়।
আমার এই কোর্ট মার্শালের ঘটনাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের আসল সেনাবাহিনীকে চেনানো। এই সেনাবাহিনীতে অন্যায় অবিচার করে কেউ পার পায়নি। অসৎ দুর্নীতিবাজ অফিসারের পাশে কেউ থাকেনা। অফিসার কিংবা সৈনিক যে'ই অপরাধ করুক না কেন সেনা আইনে তার শাস্তি হবেই।
জেনারেল ওয়াকারের যে সেনাবাহিনী আপনারা দেখছেন এখন সেটা আমাদের আসল সেনাবাহিনী নয়। খুনী হাসিনার অসৎ সহযোগী অফিসারদের সেনাবাহিনীর চিফ বাঁচাতে চাইছেন কারণ কান টানলে কার মাথাটি আসবে তা বুঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার দরকার নাই।
গুম/খুন কাজে জড়িত অফিসারদের পক্ষে আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী দাঁড়ায়না শুধুমাত্র জেনারেল ওয়াকার আর ভারতের পদলেহনকারী জেনারেলরা দাঁড়ায়।
বুঝাতে পারলাম কি?
আগের কথায় ফিরে যাই। অনেকে মনে করেন, ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল মানেই কেংগারু কোর্ট। এটি একটি ভুল ধারণা। গত ১৭ বছরে হয়তো এই কোর্টের অনেক অপব্যবহার হয়েছে কিন্তু এটা সাময়িক অনিয়ম। যেমন ধরুন, সারকামস্টেন্সিয়াল আলামত অনুযায়ী মেজর এক্স আইভরি কোস্টে তার ভাই এর পাসপোর্ট নিজে তার ব্যাটালিয়ানের অন্যান্য অফিসারদের পাসপোর্টের সাথে পাঠিয়ে ব্রিটিশ ভিসা করিয়েছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু এটার জন্য মেজর এক্সকে শাস্তি দেবার জন্য আমাকে ব্রিটিশ এ্যাম্বাসীতে পাঠানো সেই কভারিং লেটার বা এই ঘটনা দেখছে এমন একজন স্বাক্ষীর প্রয়োজন হবে। আমরা ফাইনাল ড্রাফটে সকল স্বাক্ষী এবং অভিযুক্তর সিগনেচার নিয়ে ৫২ পদাতিক ব্রিগেডে জমা দিলাম। আমাদের প্রধান সুপারিশ ছিল মেজর এক্সকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। এর মধ্যে একদিন কমান্ডার ৫২ ব্রিগেড অন্য একটি বিষয়ে স্যারের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি মেজর এক্সের ব্যাপারে তার চরম হতাশা প্রকাশ করেন।
দাপ্তরিক রীতি অনুযায়ী এই তদন্ত রিপোর্ট ব্রিগেড কমান্ডার তার সুপারিশ সহকারে তৎকালীন কুমিল্লা ডিভিশনের জিওসির কাছে পাঠানো। জিওসি তার সুপারিশ সহকারে তা সেনাসদরে পাঠাবেন এবং শেষ পর্যন্ত সেনাসদরের জ্যাক ব্রাঞ্চ তাদের ভেটিং শেষ করে সুপারিশ সহকারে সেনা প্রধানের কাছে উপস্থাপন করবেন।
আনুমানিক ২/৩ তিন মাস পর আমি জ্যাক ব্রাঞ্চের একজন মেজরের ফোন পেলাম। সে বলল, স্যার মেজর এক্সের বিষয়ে সেনাপ্রধান ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল করতে বলেছেন। আপনাকে প্রসিকিউটর নিযুক্ত করা হবে। এ বিষয়ে কুমিল্লার একিউ এর সাথে কথা হয়েছে। আপনি ডিটেইলস ইন্সট্রাকশন পেয়ে যাবেন। যদিও আমি মোটামুটি জানতাম আমাকেই প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হবে তারপরও আমার একটা মিক্সড ফিলিংস কাজ করছিল। এই প্রথম এমন একটা কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছি যেখানে আমি এক্সপার্ট নই। খোদার কাছে সাহায্য চাইলাম, আমি যেন ন্যায়পথ বেছে নিতে পারি। আমি যেন জুলুমবাজ না হই।
কিছুদিন পর আমার কাছে বিস্তারিত নির্দেশনা আসলো। প্রথমে আমাকে মেজর এক্সের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রস্তুত করতে হবে। আমি মিলিটারি ল নিয়ে ব্যাপক ঘাঁটাঘাঁটি করলাম এবং মেজর এক্স এর বিরুদ্ধে ছয়টি চার্জ প্রস্তুত করলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে প্রধান তিনটি চার্জ ছিল: এক্সটরশন, ক্রিমিনাল ইন্টিমিডেশন আর চিটিং।
এরপর আমি সেনাসদর জ্যাক ব্রাঞ্চের সাথে যোগাযোগ করি মূলত আমার চার্জশিট ফ্রেমিং এ কোন ভুল আছে কিনা সেটা বুঝার জন্য। আমি একজন মেজরের সাথে কথা বললে সে আমাকে এডভাইস করলো ২/৩ টার বেশী চার্জ না দিতে এবং সবগুলো চার্জ মিলিটারি ল সেকশন ৫৫ এ দেবার জন্য। আমি বললাম, তুমি তো মেজর এক্সের সকল আকাম কুকামের ইতিহাস জানো। এখন বলো, আমার চার্জশিটে কোন ভুল আছে কিনা! সে আমার কোন ভুলের
কথা উল্লেখ করতে না পারলেও শুধু বলল কোর্ট মার্শালে সেকশন ৫৫ এ আপনার সুবিধা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! সেনাবাহিনীর সকল অফিসার- লেঃ থেকে ক্যাপ্টেন এবং ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পরীক্ষায় এই এমবিএমএল বা মিলিটারি ল নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। আমার মিলিটারি ল এর জ্ঞান নিয়ে আমি কনফিডেন্ট ছিলাম যে আমি এই চার্জগুলো রেখেই তা কোর্টে প্রমাণ করতে পারবো। পরে আমি যেটা বুঝলাম তা হলো, সেকশন ৫৫ দিলে কোর্টের ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে অভিযুক্তকে শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে। এখানে এক্সটরশনের তিনটির মধ্যে একটি চার্জ প্রমাণিত হলেই তাকে নিশ্চিত সিভিল জেলে যেতে হবে।
আমি কনফিডেন্টলি চার্জশিট ফ্রেম করে সেনাসদরে জ্যাক ব্রাঞ্চে পাঠালাম এবং কিছুদিন পর চার্জশিট এপ্রুভাল পেল।
আপনারা ভুলে যাবেন না, "The dead cannot cry out for justice; it is a duty of the living to do so for them"! ন্যায় বিচারের স্বার্থে চলুন আমরা আপোষহীন হই।
সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত।
চলবে…….
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান