আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) চূড়ান্ত করেছে সরকার। এদিকে নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতিও প্রায় শেষের দিকে। গেল সপ্তাহে ইসি সুশীল সমাজ, নারী সমাজের প্রতিনিধি, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংলাপ সম্পন্ন করেছে। সেখানে তাদের পরামর্শকে আমলে নিয়ে কাজ করছে ইসি। তবে দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করে দলের তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি ইসি। ফলে আটকে আছে রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ যেখানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নানা পরামর্শ নিয়ে আসন্ন নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য আরপিওতে কয়েকটি নতুন বিধি সংযোজন করে আইন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায় ইসি। যেগুলো নির্বাচনের পরিবেশ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য ছিল। পোস্টাল ভোটিংয়ের বিধান চালু, একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোট, একক প্রার্থীর জামানত ৫০ হাজার টাকা, ভোট অনিয়মে ভোটকেন্দ্র নয়, পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধানসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশে। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ অনুমোদন দেয়। এতে পূর্বের নির্বাচনে ব্যবহার করা ইভিএম-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সংযোজন করা হয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ। পরিবর্তন করা হয়েছে পলাতক শব্দের ব্যাখ্যা তা হলো আদালত কর্তৃক পলাতক ঘোষণ। যেদিন আদালত কাউকে আসতে বলছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে, আসছে না; তারপর পলাতক ঘোষণা করে। বিচার চলাকালীন পলাতক হয়। আসন্ন নির্বাচনে পলাতকরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
তবে আরপিওতে আপত্তি রয়েছে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের। যেখানে বলা হয়েছেÑ জোটভুক্ত হলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ভোটের সময় অনেকে জোটভুক্ত হলে জনপ্রিয় বা বড় দলের মার্কায় ভোট করা যেত। এখন আর সে সুযোগ থাকছে না। এতে আপত্তি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আরপিও সংশোধনে অনেকগুলোতে বিএনপি সম্মত হয়েছিল। তবে ২০/১ উপ-ধারা অনুযায়ী জোটভুক্ত হলে দলগুলো অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারতেন। কিন্তু যেভাবে আরপিও পাস হলো, তাতে আকারে ছোট দলগুলো জোটবদ্ধ হতে উৎসাহিত হবে না। এমন হলে ছোট দলের বড় নেতারা সুযোগ পাবেন না। এ ধরনের আরপিও একতরফাভাবে কেন পাস করা হলো? পাস হওয়া আরপিওতে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দেয়া হবে।
অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর প্রায় সাড়ে ছয় মাস পার হলেও কাজ শেষ করতে পারেনি তারা। দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ দলগুলো বলছে, অন্যদের নিবন্ধন আটকে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইসি। অর্থাৎ এনসিপির জন্য অন্যদের নিবন্ধন আটকে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে প্রয়োজনে আদালতেও যাবে তারা। যদিও ইসি থেকে বলা হচ্ছে, এক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইসির ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক নিবন্ধনের কাজ শেষ করার কথা ছিল।
আর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা। এই অবস্থায় ৩০ সেপ্টেম্বর গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইসি জানায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়েছে। এই দুটি দল ছাড়াও নিবন্ধনের সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত আরো ১০টি রাজনৈতিক দলের তথ্য-উপাত্ত ‘অধিকতর তদন্ত’ করছে কমিশন। নিবন্ধন নিয়ে ইসির এমন সিদ্ধান্ত শুরুতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে। খোদ ইসির তদন্ত কর্মকর্তারাই প্রতিবেদন দিয়েছেন, এনসিপি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও অন্য দল দুটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা নেই। নিষ্ক্রিয় দল দুটিকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রাখায় প্রশ্ন উঠেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে এনসিপির নেতারা জাতীয় লীগের নিবন্ধনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়ে আসেন। একই সময় থেকে এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক না দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ইসি। শাপলা প্রতীক বরাদ্দ পেতে এনসিপির অনড় অবস্থান ও কয়েক দফা চিঠি পাঠানোর মধ্যে তালিকায় না থাকায় সেটি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় তারা। সর্বশেষ গেল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, শাপলা প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না তারা। নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইসির পুনর্গঠন দাবিও করেছেন দলটির নেতারা। জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) প্রাথমিক নিবন্ধন নিয়ে অভিযোগ ওঠার মধ্যেই অক্টোবরের মাঝামাঝি ফের তদন্তে নেমেছে ইসি। নিবন্ধনের পথে টিকে থাকা অন্য ১০টি দলের মাঠপর্যায়ের তথ্যও পুনরায় তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। ইসি কর্মকর্তারা জানান, রোডম্যাপ অনুযায়ী সব কাজ হচ্ছে। কাজের চাপ থাকায় ছুটির দিনেও কাজ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আরপিও চূড়ান্ত না হওয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি আটকে ছিল। এখন যেহেতু আরপিও হয়েছে খুব শিগগিরই দল নিবন্ধনের ফলাফল প্রকাশ করে তারপর সংলাপের আয়োজন করা হবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তা হতে পারে বলেও প্রত্যাশা করে তারা।