বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন-বিআরটিসির দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। পতিত হাসিনা সরকারের আমলে ভারত থেকে আমদানি করা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ডাবল ডেকার এবং বাস নিয়ে চলছে লুব্রিকেন্ট, ফুয়েল, আর খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির নামে রমরমা ব্যবসা। বিআরটিসির কাউন্টার ও বাস লিজ দেয়ার নামে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম আর হাসিনার দোসরদের পুনর্বাসন প্রকল্প। স্বৈরাচারী হাসিনার দোসররা এখনো বিআরটিসির কাউন্টার ও জায়গা দখল করে দেদার একচেটিয়া ব্যবসা করে চলেছে। তাদেরকে পুনর্বাসন করে চলেছে বর্তমান বিআরটিসির চেয়ারম্যান, পরিচালক (প্রশাসন ও অপারেশন), স্টেটের ডিজিএমসহ বিভিন্ন জেলার বিআরটিসির ডিপো ম্যানেজাররা।
সপ্তাহান্তে তারা নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করে চলেছেন। বিআরটিসির কর্মকর্তা মানেই আঙুল ফুলে কলাগাছ। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। সবাই স্ব-স্ব পদে বহাল থেকে ঘুষের বিনিময়ে হাসিনার দোসরদের ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে চলেছেন। দুদকও তাদের ব্যাপারে রহস্যজনক কারণে নীরব। অথচ দুদক সম্পদের হিসাব চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউই বৈধ আয়ের উৎস দেখাতে পারবেন না।
ইনকিলাবের অনুসন্ধানে ঢাকা হেড অফিস থেকে শুরু করে সারাদেশের জেলাগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। সিলেটের আলমপুর ডিপোর ম্যানেজার মো. রোকনুজ্জামান একটি সিন্ডিকেট গড়ে দুর্নীতি করে রিজার্ভ ট্রিপের টাকা আত্মসাৎ করেই চলেছেন। ঢাকার হেড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি রিজার্ভ ট্রিপের টাকা ছাড়াও বাস মেরামত করার নামে এবং নতুন খুরচা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের পরিবর্তে পুরাতন যন্ত্রাংশ লাগিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। এ কারণে সিলেটের বিআরটিসি ডিপোর বাস চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থায়। এসব বাস মেরামত না করায় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ বাস মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে, ট্রেনিং ইনচার্জ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার কথা বলে ঘুষ নিচ্ছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে বিতর্কিত রেজাউর রহমান ভোলাগঞ্জ রুটে ট্রিপের টাকা আত্মসাৎ করায় দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল, সেই রেজাউর রহমান ম্যানেজার সিন্ডিকেটে এখনো দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আউশকান্দি থেকে বৃন্দাবন কলেজের রিজার্ভ বিআরটিসি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৫১৯২) সাতছড়ি ভাড়া যায় আট হাজার টাকায়। কিন্তু সেল রেজিস্ট্রারে সেই ভাড়া রিজার্ভ এন্ট্রি হয়নি। একই দিন ঢাকা মেট্রো ব-১১-৫২০৭ বাসটি রিজার্ভ ভাড়া যায় ৯ হাজার টাকায়। কিন্তু রেজিস্ট্রারে সেই বাসের ভাড়াও রিজার্ভ এন্ট্রি করা হয়নি। এভাবেই পছন্দের চালকদের সঙ্গে যোগসাজশে ম্যানেজার মো. রোকনুজ্জামান সিন্ডিকেট করিয়ে পিকনিক, বিয়েসহ নানা রিজার্ভ বাসের ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে একাধিক প্রমাণ মিলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট আম্বরখানা-ভোলাগঞ্জ রুটের বিআরটিসির বাস কাউন্টার ছিল সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমেদ। তার ছত্রছায়ায় শ্রমিক লীগের রুম্মান ও রুকনের সাথে মিলে বিআরটিসির ভোলাগঞ্জ রুটের কাউন্টারে ব্যবসা করেছিলেন রেজাউর রহমান। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়ে মো. রেজাউর রহমান বিআরটিসি বাসের রিজার্ভ ও লোকাল ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি ভাড়া আত্মসাতের ঘটনায় কোম্পানিগঞ্জের আফজল হোসাইন নামের ব্যক্তি ভোলাগঞ্জ রুটের কাউন্টার মালিক রেজাউর রহমানের বিরুদ্ধে দুদক সিলেটে অভিযোগ করেছিলেন। ম্যানেজার মো. রোকনুজ্জামান সেই বিতর্কিত রেজাউর রহমানকে আবারো ভোলাগঞ্জ রুটের কাউন্টার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, সিলেট আলমপুর ডিপোর ট্রেনিং ইনচার্জ মাহবুব ২৩ জন ভিডিপি সদস্যকে ড্রাইভিংয়ে বিআরটিএ থেকে পাসের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে ৫৭ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষ লেনদেনের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ও রেকর্ডে সংরক্ষিত আছে। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল আনসার ভিডিপি সদস্যদের এই পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে একাধিক সদস্য এ বিষয়ে আনসার ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গলের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে আনসার সদস্য কবির হোসেন বলেন, আমাদের ড্রাইভিং ট্রেনিং হয়েছিল মৌলভীবাজারে। সেখানে আমরা ৩৫ জন ট্রেনিং নিয়েছিলাম। গাড়ি চালানো শিখার পরে ট্রেনিং ইনচার্জ মাহবুব সাহেব বললেন, বিআরটিএ থেকে তোমরা লাইসেন্স পেতে হলে আড়াই হাজার টাকা করে দিতে হবে। আমরা সবাই তাকে টাকা দিয়েছি। একই চিত্র দেশের সব জেলাতেই।
একইভাবে ঢাকার ফুলবাড়িয়া-গুলিস্তান ও কমলাপুর ডিপো থেকে বিআরটিসির কাউন্টার ভাড়া এবং জমি লিজ নিয়ে হাসিনার দোসররা এখনো চুটিয়ে ব্যবসা করছে। আলাপকালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা স্বীকার করে বলেছেন, হাসিনার দোসররা আওয়ামী লীগের আমলেই সব কাউন্টার ও বাস লিজ নিয়েছিল। তারা এখনো বহাল আছে। তাদের লিজ বাতিল করছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, এখানে আইনগত বিষয় আছে। এ জন্য লিজ বাতিল করা যাচ্ছে না। জানা গেছে, ইতোমধ্যে অনেক প্রফেশনাল পরিবহন ব্যবসায়ী বিআরটিসির কাউন্টার ও বাস লিজ নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান ও পরিচালক (প্রশাসন ও অপারেশন আইনের দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন প্রকল্প অব্যাহত রেখেছেন। বিনিময়ে তারা অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।
হাসিনার এপিএস লিকুর মালিকানাধীন বাস টুঙ্গীপড়া এক্সপ্রেস এখনো চলছে বিআরটিসির কাউন্টার দখল করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিসির ডিজিএম এস্টেট (চলতি দায়িত্ব) মো. গোলাম ফারুক বলেন, হাসিনার এপিএসের লিজ বাতিল করা যাবে না। কারণ তার পেছনে আছে গোপালগঞ্জ জেলা যুবদলের সেক্রেটারি নিজেই। আমরা সে কারণেই পারছি না। তবে গোপালগঞ্জ বিএনপির এক নেতা বলেছেন, এসব মিথ্যা কথা। গোলাম ফারুক নিজেই একজন ফ্যাসিস্টের দোসর। খুব চতুর প্রকৃতির এই কর্মকর্তা ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না। দুদক অনুসন্ধান করলে তার কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাবে। তিনি বিএনপিকে পাত্তাই দেন না। আর পেছনে বিএনপি বা যুবদলের নেতার দোহাই দিয়ে বেড়ান। এটি তার স্বভাব। প্রকৃত ঘটনা হলে টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেস এখন চালান গোলাম ফারুক নিজেই। তিনি মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান ও পরিচালক (প্রশাসন ও অপারেশনকে) ম্যানেজ করে রেখেছেন। টাকার জোরে সম্প্রতি তিনি লোভনীয় পোস্ট স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডিজিএম (চলতি দায়িত্ব) পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। কমলাপুর ডিপোর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, গোলাম ফারুক এমন ধুরন্ধর কর্মকর্তা যিনি অযোগ্য হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ আমলে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক দাবি করে প্রকাশ্যে ঘুষ নিতেন। এখন তিনি ভোল পাল্টালেও কাজে এতটুকু বদলাননি। বিআরটিসিকে আওয়ামী পুনর্বাসন প্রকল্প বানানোর উদ্যোক্তা এই গোলাম ফারুক নিজেই। সে কারণে তিনি সাবেক প্রধান মন্ত্রীর এপিএসের লিজের জায়গায় হাত দিতে চান না।