‘জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল’-অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) দেয়া সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে দু’মাস আগেও যদি সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই ‘বোধোদয়’ হতো তাহলে দেশের রাজনীতি হতো অন্যরকম। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর সোয়া বছর পর জয়ের এই উপলব্ধি কোনো কাজে আসছে না।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ১৮ বছর ধরে নির্যাতত দল বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে এবার ক্ষমতায় আসুকÑ কায়মনোবাক্যে প্রত্যাশা করা একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেনÑ বিএনপি কী সজীব ওয়াজেদ জয়দের মতো ভুল করতে যাচ্ছে? ১৪শ’ মানুষ হত্যা করে ভুল উপলব্ধি কি কাজে লাগছে? বিএনপি কি এখন ’৯১ সালের নির্বাচনের আগের আওয়ামী লীগের মতো ‘নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় যাব’ মানসিকতায় ভুগছে? ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে সোনিয়া গান্ধী ধরেই নেন, কংগ্রেসের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে ‘নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র। সে নির্বাচনে কংগ্রেস চেয়ে জনসমর্থন কম বিজেপি ভূমিধস বিজয়ের নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন। অথচ কংগ্রেস বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন পায়নি। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো; কিন্তু কখনো কখনো অতি আত্মবিশ্বাস আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ পলাতক। নির্বাচনের মাঠে বিএনপিকে এবার মোকাবিলা করতে হবে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় দল জামায়াতকে। কিন্তু জামায়াত যেভাবে মাঠে নেমেছে এবং বিজয় নিশ্চিতের লক্ষ্যে যা যা করণীয় সব কিছু সুপরিকল্পিতভাবে করছে; তখন বিএনপির কিছু নেতা ‘নির্বাচন হলে ক্ষমতা নিশ্চিত’ আত্মবিশ্বাসে বিভোর! লালন সাঁই লিখেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না/দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না/তুমি কেন জানলে না/সময় গেলে সাধন হবে না।’ প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি সময়কে কাজে লাগাচ্ছে? নির্বাচনের সাড়ে তিন মাস আগে যা করা দরকার, জামায়াত তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করলেও বিএনপি কি তা করছে? দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কয়েক দফায় বিএনপির নেতাকর্মী এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনগণের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘জনগণ সব, তাদের কাছে যেতে হবে’। বিএনপির নেতারা কি সেটি করছেন? ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, দরগা-মাজারের ভক্ত-অনুসারী, মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
যেকোনো নির্বাচনে বিজয়ী হতে এদের ভোট অপরিহার্য। এ বাস্তবতা বুঝতে পেরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দলীয় গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাপক পরিবর্তন এনে শেখ হাসিনা নিজেও মাথায় পট্টি বেঁধে ‘একটিবার সুযোগ দিন’-আবদার নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন। শুধু কি তাই! ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩৫ এবং জামায়াত তিনটি আসন পেয়েছিল। ওই সময় জাতীয় পার্টি সমান শত্রু মনে করত বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে। তবে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি একই চেতনার হওয়ায় এ দুই দল মিলে সরকার গঠনের সুযোগ ছিল বেশি। কিন্তু আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতা শের এ খাজার (আনওয়ারুল হক চৌধুরী) ধানমন্ডি লেকের পাশে জাহাজবাড়িতে (চিশতিয়া প্যালেস) এক বৈঠকে আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির বৈঠকের মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত হয়। কারাবন্দি এরশাদ বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেন। এ ঘটনা বলে দেয়Ñ আধ্যাত্মিক নেতা, ইসলামী চেতনার ব্যক্তিরা দেশের রাজনীতিতে পর্দার আড়ালে থেকেও কেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল, মসজিদ, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৯২ শতাংশ মুসলমান ধর্মান্ধ না হলেও ধর্মভীরু। হালে ইংরেজি মাধ্যম-বাংলা মাধ্যমের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা জেন-জি প্রজন্ম বিজাতীয় সংস্কৃতির রুখে দিতে ইসলামী সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে নির্বাচনে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তাচেতনা খুবই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ফলে যে সব দল পাওয়ার পলিটিক্স করে তারা নির্বাচনে ভোট টানতেই আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতাকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় থেকে এ ধারা চলে আসছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ বাস্তবতার নিরিখে বিএনপি পরিচালনা করেছেন এবং নির্বাচনগুলোতে ইসলামী ধারার দলগুলোকে সাথে নিয়েছিলেন। এমনকি স্বৈরশাসক এরশাদ ৯ বছরের শাসনামলে আলেম-ওলামাদের সাথে নিয়েই কাজ করেছেন। ইসলামী ধারার দলগুলো সমর্থন থাকায় দিল্লির কোনো প্রেসক্রিপশনই আওয়ামী লীগ সুবিধা করতে পারেনি। বাধ্য হয়েই শেখ হাসিনা ১৯৯৫ সালে দলের কর্মকৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এনে ইসলামী চেতনার ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করেন।
প্রশ্ন হচ্ছেÑ আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি কী করছে? জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপি এবার আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটার রাজনৈতিক শক্তি এবং মওদূদীবাদী আকিদ্বায় বিশ্বাসী জামায়াতবিরোধী ভোটারদের কাছে টানতে কেমন উদ্যোগ নিচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা সফর করেছি। সেখানে দেখেছি, মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে যারা রাজনীতি করেন না তারা বিগত দিনগুলোকে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের দৃশ্য দেখে দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। তারা বিএনপিকে ভোট দেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ইসলামী চিন্তাচেতনার মানুষের মধ্যেও একই মনোভাব দেখা গেছে। কিন্তু ভোটের মাঠে বিএনপির কোনো দেখা নেই। দলটির প্রার্থী কে হবেন বা কারা বিএনপির পক্ষে রয়েছেন সে সম্পর্কে মানুষ এখনো অন্ধকারে। অথচ আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াত প্রার্থীরা ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। একটি আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। পুরুষ কর্মীরা হাটবাজারে ঘুরছেন, জামায়াতের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। নারী কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে গৃহবধূদের মগজ ধোলাই করছেন। গ্রামের নারীদের জায়নামাজ, তসবিসহ নানা উপহার দিচ্ছেন, ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন; আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং কিছু কিছু সহায়তা করছেন, এমনকি আগামীতে আরো সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছেন। মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, পাঠাগারে যাচ্ছেন মানুষজনের সঙ্গে কথা বলছেন এবং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
জেলা উপজেলায় বসবাস করে ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা করেন এমন কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সারাদেশে প্রায় অভিন্ন চিত্র। জামায়াত কোমর বেঁধে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। অথচ বিএনপির প্রার্থীদের কোনো দেখা নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী আক্ষেপ করেন এই বলে যে, ‘সারাজীবন জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, চলেছি; এখন বিএনপিকে ভোট দেয়ার মনঃস্থির করলেও বিএনপির কোনো দেখা পাচ্ছি না।’ এমনকি যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এমন ব্যক্তিদের মগজ ধোলাই করছে জামায়াত নেতাকর্মীরা। তাদের ভোট পেতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, উপযাচক হয়ে উপকার করছেন, সাহায্য-সহায়তা করছেন; অথচ বিএনপি নেতাদের খবর নেই। বিএনপি এখনো নির্বাচনী মাঠে না নামায় জামায়াত যাদের মগজ ধোলাই করছে, তাদের অনেকেই সেখান থেকে বিএনপির দিকে ফেরানো কষ্টকর হবে।
ভারত বিএনপিকে ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী দেশটি আগামীতে ‘বাংলাদেশ মৌলবাদী’ হয়ে গেছেÑ বিশ্বদরবারে এমন প্রচারণার ক্ষেত্র তৈরি করতে জামায়াতকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। শুধু তাই নয় ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়’ জনগণের কাছে এই বার্তা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়। যার জন্য পর্দার আড়াল থেকে জামায়াতকে অলআউট সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। বিশেষ করে একযুগ আগে বিচারের নামে জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেয়ার পর জামায়াত কার্যত গর্তে ঢুকে পড়ে। ২০১৩ সালের পর জামায়াতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। ফলে দীর্ঘ এক যুগ জুলুম-নির্যাতন, হামলা-মামলা, কারাভোগÑ সব সুনামি বয়ে গেছে বিএনপি নেতাদের উপর দিয়ে। সঙ্গত কারণে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিএনপির নির্যাতিত নেতারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দখল হয়ে যাওয়া ব্যবসা, সম্পদ ফিরিয়ে নিতে প্রভাব খাটিয়েছে। আর এ সুযোগে হিন্দুত্ববাদীদের নীলনকশায় জামায়াত পরিকল্পিতভাবে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজির অভিযোগ প্রচার শুরু করে। এমনকি বিএনপির নামে ‘চাঁদাবাজ ট্যাগ’ দিচ্ছে। বটবাহিনী তৈরি করে জামায়াত-শিবির সোশ্যাল মিডিয়ায় বিএনপির নামে চাঁদাবাজ ট্যাগ প্রচার করছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। শুধু কি তাই, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, সাংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষকসহ সব শ্রেণির পেশাজীবীদের নিজেদের পক্ষে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। একজন ভুক্তভোগী দুঃখ করে বললেন, জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা যখন আগামী নির্বাচনের দলকে ক্ষমতায় নেয়ার চেষ্টায় মক্কেলদের সার্ভিস দিতে মরিয়া তখন বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ মক্কেলের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের সুযোগ পেতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপি-ব্যবসায়ী-আমলা আসামির প্রচুর টাকা। মামলা পেলেই বিপুল অর্থ হাতে আসে। বিএনপির আইনজীবীরা এ লোভ সামলাতে পারেননি। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে জামায়াত চতুর্দিকে নেমেছে; অথচ বিএনপির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
আওয়ামী লীগ ও জামায়াতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত এবং বিএনপির সঙ্গে বিগত দিনে রাজপথে আন্দোলন করেছেন এমন কয়েকটি ইসলামী ও মধ্যপন্থি দলের নেতা জানান, চিন্তাচেতনায় তারা আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। আগামী নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনী যুদ্ধে থাকবেন এমন চিন্তা এখনো ধারণ করছেন। কিন্তু বিএনপির দু’জন নেতা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টিভি চ্যানেলে ছবি প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন এবং সঙ্গে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে অথচ তাদের দেখা নেই। অন্যদিকে জামায়াতকে প্রকৃত ইসলামী দল মনে না করলেও দলটির নেতারা ইসলামী ধারার দলগুলোর নেতাদের সাথে প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বৈঠক করছেন। ইসলামী ধারার জোট গঠনের চেষ্টা করছেন। এমনকি বিপরীত আকিদ্বার পীর-মাশায়েখ, দরগা-খানকার গদিনশিনদের সঙ্গে দেখা করছেন, বৈঠক করছেন। জামায়াত নেতারা নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখছেন এবং তাদের নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য ‘প্রার্থিতা’, আর্থিক সহায়তা, প্রার্থী করে নির্বাচনী খরচ দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। একাধিক ইসলামী ধারার দলের নেতা এবং পীর হিসেবে সমাজে পরিচিত এমন একজন জানান, আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে থাকতে কি করতে হবে তার সবকিছু করবেন বলে জামায়াত নেতারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
একজন প্রবীণ সংবাদিকের ভাষায়Ñ জামায়াত নেতারা ওই আলেম-পীর ও ইসলামী ধারা নেতাদের সব ধরনের সহায়তা ও পাশে থাকার ‘ব্লাঙ্ক চেক’ দিচ্ছেন। প্রসঙ্গ তুলতেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বললেন, ইলেকশন, পলিটিক্স ও পাওয়ার পলিটিক্স এক কথা নয়। পাওয়ার পলিটিক্সে নেতারা আদর্শ নীতিনৈতিকতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন ক্ষমতা। ক্ষমতায় যাওয়া এবং এমপি-মন্ত্রী হওয়া নিশ্চয়তা পেলে পাওয়ার পলিটিক্সে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলও একজোট হয়ে ভোটযুদ্ধে নামতে পারে। আর বাস্তবতা হলোÑ বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনীতির চেয়ে পাওয়ার পলিটিক্স বেশি। সবাই এমপি-মন্ত্রী হতে চায়; সেটি না হলেও ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে সুবিধা নিতে চায়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ-বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন মাঠে ছিল ইসলামী ধারার এমন রাজনৈতিক দলগুলোকে বিএনপি গুরুত্ব না দিলে তারা জামায়াতের সঙ্গী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ বাস্তবতা বুঝতে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রয়োজন নেই; রিকশাওয়ালাও সেটি জানে বুঝে। অপ্রিয় হলেও সত্য, জামায়াত আটদলীয় জোট গঠনের লক্ষে পাঁচ দফা দাবিতে মাঠে আন্দোলন করছে।
বিগত দিনগুলোর আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল এবং পরবর্তীতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করেছে, এমন দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনে নামার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে প্রার্থী হওয়ার কথাও বলেছেন। কয়েক মাস আগে বিএনপির কেন্দ্র থেকে চিঠির মাধ্যমে শরিক দলের নেতাদের পেছনে কাজ করার জন্য দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আরো কয়েকজন নেতাকে প্রার্থী কর হবে, এমন শোনা যাচ্ছে। এটি ঠিক, শরিক দলগুলোর নেতাকে প্রার্থী করা হচ্ছে, এটি পজেটিভ সিদ্ধান্ত। নেতা হিসেবে সারাদেশে ব্যাপক পরিচিত হলেও দল ছোট এবং ভোটের দিক থেকেও তাদের তেমন অবস্থান নেই। তারপরও ওইসব নেতা নির্বাচনের মাঠে শো-পিস হিসেবে বিএনপির পক্ষে থাকবে, প্রচারণায় নামবে। আবার তারা প্রার্থী হলে জামায়াতের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় ঝড় তুলবে।
জামায়াতের বিরুদ্ধে তারা যে ভাষায় প্রচারণা চালাবেন বিএনপির অনেক নেতার পক্ষে তেমন বক্তব্য দেয়া কঠিন। তবে ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে কৌশলগত কারণে বিএনপির অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। এতে করে একদিকে ইসলামী ধারার দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট গঠনের চেষ্টা ভ-ুল হবে; পাশাপাশি আমলা, পুলিশ, তৌহিদি জনতা, পীর-মাশায়েখ, দরগা-খানকা, মাদরাসা-কওমি মাদরাসার ভোটারদের ভোট বিএনপির পক্ষে আসবে। একই সঙ্গে জামায়াত ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠা ইসলামী আন্দোলনের বিএনপিবিরোধী বয়ানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় থাকবে ইসলামী ধারার দলগুলো। ভোটের মাঠে ভোট ছাড়াও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। অথচ ইসলামী ধারার একাধিক দলের নেতা জানান, বিএনপি খোঁজখবর না নেয়ায় তারা চরমভাবে হতাশ। চিন্তাচেতনা ও ইসলামী আকিদ্বার কারণে জামায়াতকে পছন্দ করেন না; অথচ জামায়াত নেতারা নির্বাচনী সঙ্গী করতে ‘ব্লাঙ্ক চেক’ দিচ্ছে। সকাল-বিকাল যোগাযোগ করছেন; ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। জামায়াতের বিরুদ্ধে এবং বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হয়ে বছরের পর বছর পার করা কর্মী-সমর্থকরা চাপ দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যÑ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে আপনারা (নেতা) নির্বাচনের মাঠে কার পক্ষে খেলবেন ঠিক করেন। বিএনপি না নিলে অন্যপক্ষে খেলার সিদ্ধান্ত নেন।
নির্বাচনে বিজয়ী হতে যে সব কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন জামায়াত তার সবগুলোই করছে। জামায়াতের প্রার্থীরা সারাদেশে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন এবং একবারের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ চাচ্ছেন। জামায়াতের নেতারা বলছেন, বিএনপি, আওয়ামী লীগ এমনকি জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখেছেন; এবার জামায়াতকে সুযোগ দিন, কথা দিচ্ছি, ঠকবেন না। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে সুকৌশলে চালাকি করে দেশবাসীর কাছে দলটির অতীত কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত জামায়াত অন্যায় করে থাকলে আমরা দেশবাসী ও জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই। এই ক্ষমা আগেও চেয়েছি এখনো চাই’। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও জামায়াত নেতা সুকৌশলে সেটি এড়িয়ে যান। অবশ্য ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগেও এমন দেশবাসীর কাছে ক্ষমা এবং ‘একবারের জন্য সুযোগ দিন’ অনুনয়-বিনয় করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কি অপকর্ম করেছেন, জাতি হারে হারে টের পাচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান-তৎপরতা পর্যালোচনা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর রহমান। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেল জাহিদস টকে বলেছেন, বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থা অনেকটা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতোই। একসময় পাকিস্তান সহায়তা করেছে আফগানিস্তানের তালেবানদের। পাকিস্তানের সহায়তায় তালেবানরা বলিয়ান হয়ে উঠেছিল। সেই পাকিস্তানের জন্য তালেবান শাসিত আফগানিস্তান এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের সঙ্গে শুধু যুদ্ধই নয়, তালেবানরা এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বিএনপি একসময় জামায়াতকে সহায়তা করেছে। নিজেরা সহায়তা করে মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছে। এখন সেই জামায়াত এখন বিএনপির জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন এমন একাধিক নেতা বলেন, সময় থাকতে বিএনপিকে মাঠে নামতে হবে। ফসলে মাঠ ভরে রয়েছে, সে ফসল ঘরে তুলতে না পারলে দায় কার? ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে নির্বাচনে বিজয়ী হতে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপিকে দ্রুত মাঠে নামা আবশ্যক। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে রাজনৈতিক পরিপক্ব জামায়াত নির্বাচনী যুদ্ধে এগিয়ে যাবে। বিএনপির নেতাদের আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, তবে পাওয়ার পলিটিক্সের রাজনীতিতে নির্বাচনের সময় অতি আত্মবিশ্বাস থেকে প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখা আত্মহত্যার নামান্তর। লালন সাঁইয়ের ভাষায় যেমনÑ ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ তেমনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের পক্ষের শক্তিগুলোকে প্রতিপক্ষের দিকে ঠেলে দিলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মতো ‘আফসোস’ করতে হবে। প্রবাদে রয়েছেÑ ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’।