Image description
সরজমিন কুমিল্লা

কুমিল্লার গ্রামে গ্রামে চায়ের দোকানগুলোতে জমে উঠেছে নির্বাচনী আড্ডা। এসব আড্ডায় হরদম চলে ভোটের হিসাবনিকাশ, দলীয় প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক ও সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে, নির্বাচনী উদ্দীপনার সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষজনের। বিশেষ করে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং ও মুরাদনগর সীমান্তের বাসিন্দারা নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও মাদকের প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত। জেলাটির সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ই আগস্ট কয়েকটি থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। এখনো অনেক অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ পণ্য ও মাদক প্রবেশ করছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদিঘি, আমজাদের বাজার, বাদিশা, দুর্গাপুর, মিয়ার বাজার, ঘোষগাঁও ও কুড়িহর ভারতের সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি। এসব এলাকার অনেক গ্রাম সীমান্ত থেকে এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সীমান্তপথের কিছু অংশে নিয়মিত বিজিবি’র টহল থাকলেও রাতে চোরাকারবারিদের গতিবিধি বেড়ে যায়। চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র মিয়া বাজার সীমান্ত থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তবে সীমান্তপথে আসা পণ্য ও মানুষের চলাচলের অন্যতম ট্রানজিট রুট এটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাচনের সময় এই এলাকায় বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া, সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ও বুড়িচং উপজেলার শশীদল এলাকা দিয়ে নিয়মিত মাদক ও অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করছে। 

আগানগর ডিগ্রি কলেজ থেকে মাইল তিনেক উত্তরে গহীনখালি গ্রাম। সরু পথ জুড়ে ইটের সলিং বিছানো। রাস্তার দু’ধারে ফসলি জমি। পথের ধারে সবুজাচ্ছাদিত ধানের জমি। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সড়ক ধরে প্রায় ৩ কিলোমিটার হাঁটার পর সড়কের পাশে টং দোকান। বয়োবৃদ্ধ সগির আহমেদ দোকানটি চালান। গ্রামের কৃষক সারাদিন খাটুনি শেষে শরীরকে একটু প্রশান্তি দিতে টং দোকানটিতে আড্ডা দেন। শাকপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব আখমত আলী বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারি নাই। কেন্দ্রে যাওয়ার পর তারা বলছে- ভোট নাকি হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকা অবস্থায় আর কখনো ভোট দিতে পারবো না। এবার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু চাই ভোটটা যেন সুষ্ঠুভাবে দিতে পারি। তিনি আরও বলেন, এখন আরও ভয় কাজ করে- ভোটের আগে অস্ত্রের ঝনঝনানি হবে কিনা। প্রায় পোলাপান কিছু হলে অস্ত্র নিয়ে বের হয়। এ জেলা সীমান্তবর্তী হওয়ায় সীমান্ত দিয়ে অনেক মাদক আর অস্ত্র চোরাচালান হয়। আমারা সাধারণ মানুষ বাপু শুধু একটাই চাওয়া- কোনোরকম ঝামেলা ছাড়া যেন ভোটটা দিতে পারি। 

কান্দিরপাড় থেকে মিয়া বাজারে যাওয়ার সময় কথা হয় প্রবাসী আবদুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, চৌদ্দগ্রামের মিয়া বাজারে সব দিকের মানুষ আসে। অনেক সময় সীমান্ত দিয়ে লোকজন মাল নিয়ে আসে, আবার কিছু মালামাল রাতে চলে যায়। সীমান্ত থেকে যা আসে, তা মিয়া বাজারেই জমে। মাঝেমধ্যে পুলিশ বিজিবি ধরে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার আগের মতো চালান হয়। এ এলাকায় অনেকে মাদক সেবন করতে আসে। তিনি আরও বলেন, অনেক অবৈধ অস্ত্র ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া থানা থেকে লুটকৃত অস্ত্র তো আছেই। আমরা আশঙ্কা করছি নির্বাচনে এসব অস্ত্রের ব্যবহার হবে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোটটা দিতে পারলেই বাঁচি, আর আওয়ামী লীগ আমলের মতো খুনখারাবি দেখতে চাই না। 

বিকাল ৫টা। সদর উপজেলার গোলাবাড়ি এলাকায় কয়েকজন নারী বস্তা নিয়ে ছোটাছুটি করছে। একটু দূরে বিজিবি’র ক্যাম্পে দেখা যায়- কিছু নারী বিজিবি’র অবস্থান ফোনে একে-অপরকে জানিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু নারী সিএনজিতে বসে আছেন। হঠাৎ করেই একটি সিএনজি, যার মধ্যে কয়েকটি বস্তা রয়েছে, গোমতী নদীর তীর ঘেঁষে দ্রুত চলতে শুরু করে। পুরো ঘটনাটি যেন একটি চোর-পুলিশ খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দোকানে সিএনজিচালক আফতাব হোসেনের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, এখানে ভারতীয় পণ্য, অস্ত্র এবং মাদক চোরাচালান হয়। যেগুলো ওই সিএনজিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১০ বস্তা চিনি রয়েছে। যদি এগুলো রাজগঞ্জ বাজারে পৌঁছাতে পারে, তবে প্রতি বস্তা থেকে ২০০ টাকা কমিশন পাওয়া যাবে। তিনি জানান, এখানে পণ্য আনা-নেয়া করার কাজটি মূলত নারীরা করে। বিজিবি গ্রেপ্তার করলে মালামাল নিয়ে যায়, কিন্তু তাদের সাধারণত গ্রেপ্তার করা হয় না।

আফতাব হোসেন বলেন, শুধু এখানেই নয়, শশীদল রেলস্টেশন দিয়েও নিয়মিত এসব পণ্য আনা হয়। যারা এসব পণ্য আনে, তাদের থানা থেকে আলাদা কার্ড করা থাকে, যাতে পথে পুলিশ তাদের বাধা না দেয়। পুলিশও মাসে মাসে তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। একটি বড় চক্র এই চোরাচালান কাজে জড়িত এবং চক্রটি প্রতিটি সীমান্তে সক্রিয়। তিনি বলেন, মাদক ও অস্ত্র পাচারও নিয়মিত ঘটে। অনেকেই সীমান্তে এসে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও মদ সেবন করে। কিছু কিছু বাড়ি রয়েছে যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রবেশ করে না, এসব বাড়িতে বাইরে থেকে অনেকে এসে মাদক সেবন করে। 

মুরাদনগরের আকুবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, মুরাদনগর কসবার কাছে হওয়ায় এ এলাকায় ফেনসিডিল, ইয়াবা ও অস্ত্র আসে। স্থানীয় ডিলাররা পরে এগুলো ছড়িয়ে দেয়। আমরা আশঙ্কা করছি এসব জায়গা দিয়ে পাচার অস্ত্রগুলো নির্বাচনে ব্যবহার হবে। আমরা চাই যেন নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি না ঘটে, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে আমরা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারিনি। অনেক কষ্টে ভোট দেয়ার সুযোগ এসেছে। এবার যদি কেউ বাধা দিতে আসে তাহলে প্রতিহত করবো। 

মিয়া বাজার কলেজ শিক্ষার্থী সাকিল বলেন, রাতে মাঝেমধ্যে অচেনা মোটরসাইকেল বা পিকআপ সীমান্ত দিক থেকে আসে। আমরা ভয় পাই, এসব গাড়ি কী বহন করে- তা জানি না। নির্বাচনের সময় এসব বাড়ে। চৌদ্দগ্রাম সীমান্তের ওপারে ভারতের বাজার ঘেঁষে যোগাযোগ আছে। জগন্নাথদিঘি, বাদিশা, আমজাদের বাজার ও মিয়া বাজার এলাকা মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের খনি। ভোটের আগে-পরে এসব চালান বেড়ে যায়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে চাই।