
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে প্লট/ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি, সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি-ভোগান্তি, ঘুষ লেনদেন প্রভৃতি কাহিনী অনেক পুরনো। তবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এরসঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে আরেকটি গুরুতর বিষয়। তা হলো, সরকারের নির্ধারিত বিধি-বিধান অনুযায়ী প্লটের মূল্য বা জরিমানার অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা, যার নজির অতীতে নেই। নানা রকমের জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের নির্ধারিত ফি বা প্লটের মূল্য কম আদায় করা হচ্ছে। অবৈধভাবে ছাড়া দেয়া বাকি অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজচক্র। অতীতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বা ঊর্ধ্বতন কমকর্তাদের কেউ এভাবে সরাসরি অর্থ লোপাটের সাহস দেখাননি তেমন একটা, যা এ আমলে হরহামেশাই হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে ওএসডি হওয়া সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল বাসিরের হাত দিয়ে এ রকমের বেশ কয়েকটি জালিয়াতি হয়েছে। এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। এ ধরনের দুর্নীতি-জালিয়াতি হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও নানা কৌশলে ছাড় দিচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বরাদ্দ নির্দেশিকা অনুযায়ী খণ্ড জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে মূল্য আদায় করার কথা দুই গুণ (প্রথম দফার খণ্ড জমির ক্ষেত্রে) অথবা তিন গুণ (দ্বিতীয় দফার খণ্ড জমির ক্ষেত্রে)। অথচ বিধি-বিধানের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো মূল্য আদায় করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিলম্ব ফি বা জরিমানা আদায়ের বিষয়েও এ রকমের অনিয়ম চলছে। বিধিমালার ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে কখনও ২১ শতাংশ, কখনও ১৬ শতাংশ, আবার কখনও ১১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি আদায় করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম হালিশহর হাউজিং এস্টেটের ‘এ’ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ২৯ নম্বর প্লটের খণ্ড জমির মূল্য বরাদ্দ নির্দেশিকা- ২০০৮ (সংশোধিত-২৪) অনুযায়ী নির্ধারণ না করে নামেমাত্র কিছু জরিমানা আদায় করা হয়েছে বরাদ্দ প্রাপকের কাছ থেকে। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার ৯শ’ ৬২ টাকা। এ সংক্রান্ত বোর্ডসভার আলোচনা ও সিদ্ধান্তে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তখনকার সদস্য (পরিকল্পনা, নকশা ও বিশেষ প্রকল্প) এমন অবৈধ কমর্কাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি সভায় নোট অব ডিসেন্টও দিয়েছেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে তখন চেয়ারম্যান পদে ছিলেন সৈয়দ নুরুল বাসির। নুরুল বাসিরের সঙ্গে এ নিয়ে তখনকার সদস্য (পরিকল্পনা, নকশা ও বিশেষ প্রকল্প) প্রকৌশলী খাইরুল ইসলামের বাক-বিতণ্ডাও হয় বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও ঠেকাতে পারেননি নুরল বাসিরসহ দুর্নীতিবাজ চক্রের অপকর্ম।
জানা যায়, চট্টগ্রাম হালিশহর হাউজিং এস্টেটের এই প্লটটির বরাদ্দ প্রাপক হলেন সেলিনা সুলতানা। সেলিনা সুলতানাকে আলোচ্য মূল প্লটের (প্লট নং ২৯) সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে এ পর্যন্ত মোট তিন দফায় আলাদাভাবে খণ্ড জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। যা অবাক করার মতো ঘটনা-ই বটে! একেতো নজিরবিহীনভাবে বিভিন্ন সময়ে তিনটি খণ্ড জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, এখন আবার তার কাছ থেকে সরকারের প্রাপ্য অর্থ আদায়েও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ছাড় দেয়া হয়েছে।
এই প্লটিটির খণ্ড জমির মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য বোর্ডসভায় দুটি হিসাব তুলে ধরা হয়। তাতে বলায় হয়, বরাদ্দ নির্দেশিকা-২০০৮ (সংশোধিত-২০১৬) অনুযায়ী খণ্ড জমির মূল্য প্রচলিত মূল্যের দ্বিগুণ হারে হিসাব করা হলে মূল্য দাঁড়াবে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৬৮ হাজার ১শ’ ৩৫ টাকা। অন্যদিকে প্লটের বিপরীতে ২১% হারে বিলম্ব জরিমানাসহ ২৬ লাখ ৩ হাজার ৩শ’ ৮ টাকা দাঁড়াবে। এরমধ্যে কোনটি আদায় করা হবে, বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হয়। বোর্ড সভার আলোচনায় সদস্য (পরিকল্পনা, নকশা ও বিশেষ প্রকল্প) প্রকৌশলী খাইরুল ইসলাম সভার মতামত দেন, যেহেতু বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০২৪ সালের বরাদ্দ নির্দেশিকা কার্যকর হওয়ার পর তাই সর্বশেষ সংশোধিত এই নিদেশিকাটি অনুসরণ করতে হবে।
কিন্তু বোর্ড সভায় বরাদ্দ নির্দেশিকা সংশোধিত-২০২৪ অনুযায়ী কোনো প্রস্তাবই উপস্থাপন করা হয়নি। যদিও এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। বরাদ্দ নির্দেশিকা ২০১৬ সালের সংশোধনে খণ্ড জমির মূল্য দ্বিগুণ হারে আদায়ের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০২৪ সালের সংশোধনে একই ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার খণ্ড জমি বরাদ্দ দেয়া হলে সেক্ষেত্রে জমির মূল্য তিন গুণ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে এই খণ্ড জমিটির মূল্য দাঁড়াবে ২ কোটি ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার ২শ, ৭০ টাকা। অথচ নিয়ম-কানুনের কোনো রকমের তোয়াক্কা না করেই, এমনকি একজন বোর্ড সদস্যের ‘নোট ও ডিসেন্ট’র পরও চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল বাসির প্লটটির বরাদ্দ প্রাপক সেলিনা সুলতানার কাছ থেকে মাত্র ২৬ লাখ ৩ হাজার ৩শ’ ৮ টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন। অন্য দু’জন দুর্নীতিবাজ সদস্যও এ দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এরা হলেন তখনকার সদস্য, প্রশাসন ও অর্থ কাজী আতিয়ুর রহমান এবং সদস্য, ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এস এম সোহরাব হোসেন। এদের দুর্নীতি-অপকর্মের কারণে শুধু এই প্লটটির ক্ষেত্রেই সরকারের ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার ৯শ’ ৬২ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এই টাকা দুর্নীতিবাজচক্রের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
আরেকটি ঘটনায় মিরপুর সেকশন-১০, ব্লক বি, মেইন রোডের ১৭৩ বাণিজ্যিক প্লট নং ১/এ-এর বকেয়া পরিশোধের বিবরণী থেকে দেখা গেছে, এখানে শাহজাহান মিয়া নামে আরেকজনের কাছে ২ হাজার ৪০০ বর্গগজ অর্থাৎ ৩০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয় জাগৃক। বরাদ্দ নির্দেশিকা ও সবগুলো বোর্ড সভার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় বিলম্বকালীন ফি/সুদ ছাড়া শুধু কিস্তির আসল টাকা পরিশোধ করা যাবে না। কিন্তু আলমগীর হুছাইন বিলম্ব ফি বাদ দেওয়ার জন্য সময় সময় হিসাব পরিবর্তন করেছেন। তিনি জাগৃকের প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে গত ২৭ মে প্লটটির জন্য ১৬ শতাংশ বিলম্ব ফিসহ ২ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা বকেয়া আদায় করার চিঠি প্রস্তুত করেন। কিন্তু চালান পাস করান ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার। বাড়তি ৭৫ হাজার ২০০ টাকার হিসাব দেখাতে পারেননি। জানা গেছে, এই ৭৫ হাজার ২০০ টাকাও গায়েব করার চেষ্টা করছেন আলমগীর হুছাইন। কিন্তু বরাদ্দ নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে আদায় করার কথা ৩ কোটি ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ২০০ টাকা। এখানেও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কারণ, শুরু থেকে ২১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি আদায় করার নির্দেশনা ছিল। সেটা কেটে ১৬ শতাংশ করা হয়েছে।
জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অর্থ আত্বসাতের এসব দুর্নীতির অন্যতম হোতা হলেন সংস্থাটির সাবেক পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) আলমগীর হুছাইন, বর্তমানে যিনি সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) পদে উন্নীত হয়েছেন। এবং এর সঙ্গে রয়েছেন- সহকারী পরিচালক (অর্থ) মামুনুর রশীদ। এ সংক্রান্ত নথিতে অনিয়ম পাওয়ায় সংস্থাটির উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) গুলরুখ খাদিজা জাহান নথিতে স্বাক্ষর না করে তা ফেরত পাঠান। কিন্তু দেখা যায়, এই পর্যায়ে দুর্নীতিবাজচক্র এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) এর স্থানে উপপরিচালক (প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ) মো. মুশফিকুল ইসলামকে দিয়ে নথিতে স্বাক্ষর করায়, যদিও এটি সম্পূর্ণ অবৈধ।
মিরপুরের রূপনগর গভঃ হাউজিং এস্টেট বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে ৬০ ফুট প্রশস্ত প্রধান সড়ক সংলগ্ন ৩নং প্রাতিষ্ঠানিক প্লাটটির পরিবর্তে সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকার সেকশন-৮, ব্লক-খ, প্রধান সড়কের ১নং পুনর্বাসন প্লটের পূর্ব দিকে অবরাদ্দকৃত কম/বেশি ২০ কাঠা জমি (খালি সাপেক্ষ) প্রাতিষ্ঠানিক প্লটের ফরমেট নকশা অনুমোদনসহ বিকল্প বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় জাগৃকের ২৬৮তম বোর্ড সভায়। তবে মূল বরাদ্দপত্রে ওই জমির পরিমাণের চেয়ে বিকল্প বরাদ্দকৃত প্লটের জমির পরিমাণ বাড়লে বাড়তি জমির মূল্য প্রচলিত মূল্যের দ্বিগুণ হারে এককালীন পরিশোধ করতে হবে এবং বিকল্প হিসেবে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ আদায় করতে হবে- এই ছিল বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত। প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দকৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্লটটির আয়তনের চেয়ে বিকল্প বরাদ্দকৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্লটটির আয়তন ৪.৮০ কাঠা বেশি হওয়ায় ওই ৪.৮০ কাঠা জমির মূল্য প্রচলিত মূল্যের দ্বিগুণ হারে এককালীন আদায় করার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
জাগৃকের সবশেষ প্লট/ফ্ল্যাট বরাদ্দ নির্দেশিকা, ২০০৮ (সংশোধিত-২০২৪) এবং সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৫৯ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা সংলগ্ন জমির প্রচলিত মূল্য প্রতি কাঠা ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত। ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী প্লটটির মূল্য হওয়ার কথা ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু বোর্ড সভায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার চালান পাস করা হয় গত ২৩ জুলাই। চালান প্রস্তুতকারীর জায়গায় স্বাক্ষর করেন হিসাবরক্ষক শাহাব উদ্দিন আর চালান পাসকারী কর্মকর্তার জায়গায় সহকারী পরিচালক (অর্থ) মামুনুর রশীদ। চালান পাস করার পর ২০২৫ সালের ২১ আগস্ট ২৬৮তম বোর্ড সভায় হিসাবে হেরফের দেখে আইন কর্মকর্তার মতামত নিতে বলেন বর্তমান চেয়ারম্যান মোসা. ফেরদৌসী বেগম। চালান পাস হয় জুলাইয়ে আর আইনি মতামত নিতে বলা হয় আগস্টে। অর্থাৎ, চালান অনুমোদনের সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষনিউজ