Image description
 

বরিশালে বাকেরগঞ্জে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ শিকারের মহোৎসব চলছে। প্রশাসন ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে নদীতে পাহারা বসালেও ইলিশ নিধন রোধ করতে পারছে না। বরং প্রতিনিয়ত জেলেদের ছোট-বড় হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এতে পুলিশ সহ মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারা গুরুতর আহত হওয়ার খবরও রয়েছে। ইলিশ নিধনবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে বারবার অস্ত্রধারী জেলেদের হামলা প্রশাসনের এক ধরনের অসহায়ত্বের কথা জানান দিচ্ছে, যা নিয়ে স্থানীয় মৎস্য প্রশাসন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।

 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ অক্টোবর থেকে চলমান ইলিশ নিধনবিরোধী প্রশাসনের আভিযানিক টিমের ওপর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা হামলা হয়েছে। ট্রলার, স্পিডবোট নিয়ে অভিযানে অংশ নিতে গেলে সঙ্গবদ্ধ জেলেরা দূর থেকে ইট-পাথর ছুড়ে ধারালো অস্ত্রসহ তেড়ে আসে।

আজ ২০ অক্টোবর দুপুর ১ টায় তেতুলিয়া নদীর অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত বিষারীকাঠি নামক স্থানে দুপুর ১ টায় আভিযানিক টিমের ওপর স্থানীয় সঙ্গবদ্ধ জেলেরা হামলা চালায়। এই হামলায় উপজেলা মৎস্য অফিসের ডাটা এনুমারেটর মোঃ সাদ্দাম হোসেন, লিফ, CSWMP প্রকল্পের মোঃ জসিম উদ্দিন ও বোটের মাঝিসহ পুলিশের এএসআই হুমায়ুন ও কনস্টেবল প্রান্ত সহ ৫ জন আহত হন। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে জেলেদের উপর ৬ রাউন্ড গুলি ছোড়লে জেলেরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

 

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, দাড়িয়াল ইউনিয়নের বিষারীকাঠি নামক স্থানের তেতুলিয়া নদীতে মৎস্য প্রশাসন পুলিশ প্রশাসন হাতে নিয়ে ইলিশ নিধনবিরোধী অভিযানে অংশ নেন। তাদের কাছে খবর ছিল, তেতুলিয়া নদীর অভয়াশ্রমের আশপাশে অন্তত অর্ধশত জেলে নৌকা নিয়ে ইলিশ নিধন করছেন। আভিযানিক টিম অগ্রসর হলে জেলেরা ইট-পাথর ছুঁড়তে থাকেন। একপর্যায়ে প্রশাসনের নৌযানটি জেলে ট্রলারের কাছাকাছি গেলে মৎস্যজীবীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করে। এ সময় মৎস্য দুই পুলিশ সদস্য সহ মৎস্য অফিসের কর্মরত লোকজন আহত হয়। 

 

এর আগে গত ৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের সময় মৎস্য বিভাগের ট্রলারে হামলা চালায় জেলেরা। ওই হামলার ঘটনায় ১১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৭ জনকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে জরিমানা করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তন্ময় হালদার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এ দণ্ড প্রদান করেন।

জানাযায় ঐ অভিযানে, দাঁড়িয়াল ইউনিয়নের বিশারিকাঠী এলাকায় একটি ট্রলারে অভিযান চালায় মৎস্য বিভাগ। এসময় স্থানীয় কয়েকজন জেলে অভিযানরত কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়। পরে পুলিশ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনকে আটক করে।

এই হামলার কথা স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, মৎস্য প্রশাসনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইলিশ নিধন রোধে নদীতে নেমে জেলেদের কাছে এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। সারিবদ্ধভাবে জেলেরা জাল ফেলে ইলিশ শিকার করছে, তাদের রুখতে গেলে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এ সময় নিজেদের কাছে থাকা অস্ত্র আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করেছেন। তবে জেলেরা এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন, নিজেদের অসহায় মনে হচ্ছে।

অভিযানে গিয়ে বারবার জেলেদের হামলার ঘটনায় মৎস্য প্রশাসনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনবল এবং আধুনিক নৌযান সংকটের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষ করে তেতুলিয়া নদীতে ইলিশ শিকার এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিহীন একটি নৌযান নিয়ে হানা দেওয়ার একটি ভিডিও রীতিমতো আলোচনার ঝড় তুলেছে।

ভিডিও-চিত্রে দেখা যায়, তেতুলিয়া নদীতে দিনেরবেলা শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে জেলেরা ইলিশ শিকার করছেন। দুর্বল গতির একটি স্পিড বোট নিয়ে সেখানে হানা দিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু নাগালে যাওয়ার আগেই জেলে দ্রুতগতির ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো স্থান ত্যাগ করে, যা নির্বাক হয়ে দেখেছেন কর্মকর্তারা। নদীতে প্রশাসনের এই অসহায়ত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। বাকেরগঞ্জ সহ বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলের সব কটি জেলা মৎস্য প্রশাসনই নদীতে কচ্ছপের মতো নৌযান নিয়ে টহল দিচ্ছে, আর জেলেরা গতিসম্পন্ন নৌকা নিয়ে নির্ভয়ে ইলিশ শিকার করছেন। নৌযানসংকট এবং হামলার সম্ভাব্য আশঙ্কা থাকলেও ইলিশ নিধন রোধে বাকেরগঞ্জ মৎস্য বিভাগ সর্বদা নদীতে সরব রয়েছে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, গত ৪ অক্টোবর থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত দপ্তরটি ৪৮ টি অভিযানে অংশ নিয়েছে। পুলিশ, কোস্ট গার্ড, আনসার এবং উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে মোবাইল কোর্ট গঠন করে অভিযান চালানো হয়। এখন পর্যন্ত ৪৮ টি অভিযানে ৪৮ টি মামলায় ১৬ জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। 
অভিযান চালাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত স্থানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। তবে আজ বড় হামলা হয়েছে, এতে পুলিশ সহ পাঁচ জন আহত হয়েছে। পুলিশ নিজের আত্মরক্ষার্থে গুলি বর্ষণ করেছে। না হয় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। 

প্রশাসন কি ভয়ে অসাধু জেলেদের কাছে নতি স্বীকার করল? এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের উপপরিচালক কামরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, লোকবলের পাশাপাশি আধুনিক নৌযান সংকট তাদের ভোগাচ্ছে। তা ছাড়া একশ্রেণির জেলে আইন মানতে চাইছেন না। এমনকি নিষেধাজ্ঞার সময়ে তাদের চালসহ সহযোগিতা করেও ঘরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে মৌসুমি জেলেরাও সক্রিয় হয়েছেন। তাদের রুখতে গিয়ে নদীতে একাধিকবার প্রশাসন আঘাতপ্রাপ্ত হতে হচ্ছে। ফলে এবারের মৌসুম ইলিশ প্রজননে সরকার কতটা সফল হবে তা নিয়েও থেকে যাচ্ছে সংশয়।