Image description
 

আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, আপনারা মন খারাপ করবেন না, আপনাদের ছেলে মেয়েদের গল্প সারা পৃথিবীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী আলোচিত হবে। আমি মনে করি, এ বিপ্লব শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী আলোচিত হবে।

 
 

সোমবার (২০ অক্টোবর) সকালে নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার দেশ পাঠকমেলা কুমিল্লা জেলা কর্তৃক আয়োজিত মহান ৩৬ জুলাই যোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।

 

তিনি আরো বলেন, যেই মুহূর্তে আমাদের সন্তানেরা মৃত্যুকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে, সেই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ পালাতে বাধ্য হয়েছে। কারণ আমাদের তরুণেরা কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নয়, তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছে। নিরস্ত্র তরুণ-তরুণীরা এই যুদ্ধে নিজের শক্তি এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।

 

আজ থেকে ৫০ বছর আগে মারা যাওয়া চে গুয়েভারাকে মহানায়ক হিসেবে জানতাম। আজকের মহানায়ক হলো আবু সাইদ, আজকের মহানায়ক মুগ্ধ ও ওয়াসিমের মতো শহীদরা। এরা আমাদের মহানায়ক। আমাদের আর বাইরে থেকে মহানায়ক আনতে হবে না।

 

শহীদ পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের অনেক চাহিদা পূরণ হয়নি— আমরা জানি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমার দেশ তার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

 

আজকে কুমিল্লা পাঠকমেলা যে আয়োজন করেছে, তা আপনাদের অবদানের কাছে কিছুই না। কিন্তু আপনাদের জন্য আয়োজন করতে পেরে আমরা সম্মানিত বোধ করছি।

 

জুলাই যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ও আহতদেরকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মহান জুলাই না আসলে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতাম না। এই মহান জুলাই সংঘটিত না হলে আমার দেশ পুনঃপ্রকাশ হতো না। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ফিরে পেত না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব ফিরে পেত না।

 

এগুলো সবই সম্ভব হয়েছে আপনাদের সন্তানদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আপনারা কাঁদবেন না, আপনারা গর্ব করবেন। সমগ্র জাতি তাদের জন্যই গর্ব করে। আমার দেশ পত্রিকা তাদের জন্য আলাদাভাবে কাজ করছে। আমাদের মন থেকে তারা কখনো সরে যায় না। সার্বক্ষণিক আমাদের স্মরণে থাকে।

 

তিনি আরো বলেন, দুঃখের বিষয় হলো -আমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। আমরা যখন পত্রিকা বের করা শুরু করলাম, তখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আগে তো আমাদের জন্য সহজ ছিল, কারণ আমরা তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লিখতাম। এখন যাদের সম্পর্কে লিখতে হবে তারা সবাই জুলাই যোদ্ধা— বিএনপি জুলাই যোদ্ধা, জামায়াতে ইসলামী জুলাই যোদ্ধা, এনসিপি জুলাই যোদ্ধা— তারা জুলাইয়ের মহানায়ক, তারা জুলাইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছে।

 

তিনি আরো বলেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে লিখব? কিন্তু লিখতে তো হবে— তারা তো ভুল করে, সব তো আর সঠিক করছে না। এনসিপি আমার সন্তানতুল্য, বিএনপি-জামায়াত আমার বন্ধু। তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে লিখতে হবে। কারণ সংবাদপত্রটাই এমন।

 

সবাই এখন সরকারে যেতে চায়— তাহলে আপনি কার পক্ষে লিখবেন, কার মন জয় করবেন? যার বিপক্ষে যাবেন, সেই তো শত্রু হয়ে যাবে।

 

যদি আপনি সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক হতে চান, তাহলে পত্রিকা চালানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। সংবাদপত্রের কাজ প্রতিদিন লড়াই করা। এটা আপনাকে প্রতিদিন নতুন সংবাদ দিচ্ছে। এটা ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেই বাসি হয়ে যায়।

 

ফ্যাসিবাদী সরকারের ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের কাছে একটা সংবাদ আসলো— তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। সেই সংবাদ আমরা ছাপাবো কিনা— এটা একটা বড় সিদ্ধান্ত ছিল। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নিউজ ছাপাবো।

 

সেই সংবাদ থেকেই আমার সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত লড়াই শুরু হয় এবং আমি জেনেশুনেই সেই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলাম। আমি জানতাম এর প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়ংকর হতে পারে।

 

হাসিনার বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সালে আমরা বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের জুডিশিয়ারি শেখ হাসিনার তদবির বাহনের ভূমিকা পালন করছে। দেশের সুপ্রিম কোর্টসহ সবাই একই কাজে জড়িত। তারা রায় দিচ্ছে —‘শেখ হাসিনা দেখতে সুন্দরী।’ তখন আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম— এটার বিরুদ্ধে আমি লিখব কিনা। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখব। তারপর আমি একটি আর্টিকেল লিখলাম— ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’।

এটা লেখার কারণে আমার নামে মামলা হলো, সাজা হলো, পত্রিকা প্রথমবারের মতো বন্ধ হলো— কয়েক সপ্তাহ বন্ধ ছিল। আমি এক বছর জেল খেটে বের হলাম। তারপরেও আমি আমার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি।

 

স্কাইপ কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বলেন, এরপরে বড় পরীক্ষা আসলো— যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে। তখনকার কথিত বিচারকরা আগে থেকেই রায় ঠিক করে রাখতো এবং বলা হচ্ছিল, ‘সবাইকে ফাঁসির রায় দেয়া হবে’। তখনো আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এটার বিরুদ্ধে লিখব।

 

আমরা স্কাইপ কেলেঙ্কারি বের করলাম— বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত ইনভেস্টিগেশন নিউজ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল এটা।

 

এখন যেটা ডিজিটাল আইন, সেটা শুরু হয় আইসিটি অ্যাক্ট থেকে। আমি এবং আমার দেশ ছিলাম সেটার প্রথম আসামি। আমি বন্দি জীবন যাপন শুরু করলাম অফিসের ভিতরে। দীর্ঘ চার মাস বন্দি জীবন পার করলাম।

 

এরপর আমি আরেক পরীক্ষায় পড়লাম— গণজাগরণ মঞ্চ নামে ভারতীয় এজেন্টরা শাহবাগে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে নামলো। তখনকার সকল মিডিয়াও তাদের পক্ষে অবস্থান নিল। বাংলাদেশের বিরোধীমত এবং ইসলামকে দূর করার ভয়ংকর সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে আমি এর বিপক্ষে লিখলাম —‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’।

 

তারপর আর আমি বেশিদিন এ দেশে টিকতে পারলাম না। আমি গ্রেপ্তার হলাম। ২০১৩ সালের ১১ই এপ্রিল আমার পত্রিকা বন্ধ হলো, প্রেসে তালা দেয়া হলো এবং পুলিশের সামনে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়া হলো।

 

তারপর জেলে গেলাম— চার বছর জেল খাটলাম। রিমান্ডে নিলো, পুলিশের অত্যাচার সহ্য করলাম। তার এক বছর পর কুষ্টিয়াতে আদালতের সামনে আমার উপর হামলা হলো, রক্তাক্ত হলাম, আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেলাম।

 

তারপর দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম, কারণ তখন মনে হলো দেশে থাকলে তো গুম হয়ে যেতে হবে। তার চেয়ে বাইরে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও তো ভালো হয়— এবং সেটা উচিত।

 

এই কারণেই সিদ্ধান্ত নিলাম, বাইরে থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। সেই যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারিনি, কিন্তু একটা পটভূমি তৈরি করতে পেরেছিলাম। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সন্তানেরা জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করেছে।

 

তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। যখন তারা ফ্যাসিস্টদের বুঝাতে পেরেছে, তারা জীবনের মায়া করে না— মায়া ত্যাগ করেই রাস্তায় নেমেছে— তখনই ফ্যাসিস্ট পালিয়ে গেছে।

 

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের আমির কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. হায়দার আলী, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কলামিস্ট এম আব্দুল্লাহ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ মহাসচিব ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, এবি পার্টির কুমিল্লা জেলা সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ তৌফিক, কুমিল্লা ইবনে তাইমিয়া স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সফিকুর রহমান হেলাল, কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি জহিরুল হক দুলাল, এনসিপির কুমিল্লা মহানগর যুগ্ম-সমন্বয়ক রাশেদুল হাসান।

আমার দেশ পরিচালক ড. শাকিল ওয়াহেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম জাহিদ চৌধুরী, আমার দেশ মফস্বল সম্পাদক আবু দারদা জোবায়ের।

 

আমার দেশ পাঠকমেলা কুমিল্লা জেলার সভাপতি ডা. আরিফ মোর্শেদ খানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আমার দেশ পাঠকমেলা কুমিল্লা জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মনির‌। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন শহীদ হামিদুর রহমান সাদমানের মা কাজী শারমিন, শহীদ মুনতাসির রহমানের বাবা সৈয়দ গাজীউর রহমান। আমার দেশ কুমিল্লা প্রতিনিধি এম হাসানের সঞ্চালনায় কুমিল্লার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

 

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কুমিল্লায় শহীদ ৩৯ জনের পরিবার ও ২০ জন আহত সদস্যদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।