
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ছেলে টিপুর ব্যাপকহারে তদবির বাণিজ্য ও ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার খবর এখন সচেতন মহলের কারো অজানা নেই। বিশেষ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরে টিপু আলোচিত একটি নাম। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে টিপু গুলশানে একটি তদবির বাণিজ্যের অফিসও খুলে বসেছেন, যা ইতিপূর্বের একাধিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ছেলে টিপুর বেপরোয়া তদবির বাণিজ্য ও ঘুষ লেনদেন সম্পর্কে খাদ্য অধিদপ্তরে সর্বশেষ একটি চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বেশি অংকের ঘুষ আদায়ের জন্য তিনি অনেকটা খোলাখুলিভাবে নিজের পারিবারিক দুর্বলতার কথাও তুলে ধরছেন। টিপু তাদের কাছে ঘুষের বিষয়টাতে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, “ভাই, আমার দিকে তাকাইয়েন; দুই বিয়া করছি। পরের বিয়েটার শশুর বাড়ি একেবারে ফকিন্নি। আমারই চালাইতে হয়। আপনারা কেউ দুই বিয়া কইরেন না।” খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা শীর্ষকাগজ প্রতিবেদককে এ ধরনের একই কথা জানিয়েছেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিতর্কিত উপদেষ্টা হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন আলী ইমাম মজুমদার। নানা কারণেই তিনি আলোচিত। শুরুতে তিনি দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিশেষ সহকারী হিসেবে। জনপ্রশাসন দেখার দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। তখনই তিনি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন। এরপরে তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এই সময় তার বিরুদ্ধে সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপকহারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। তাকে উপদেষ্টা পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠে। সচিবালয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে সরকার বাধ্য হয় দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা হিসেবে রাখতে। কিন্তু এটি ছিল আদতে একটা কৌশল। তখন আলী ইমাম মজুমদারই ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। আনঅফিসিয়ালি প্রশাসনসহ সবকিছুই তিনি দেখতেন। তাঁর ইচ্ছের বাইরে কিছুই হতো না। এই সুযোগকে কাজে তিনি ব্যাপকহারে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রশাসনে পদোন্নতি-পদায়নে অনিয়ম, ফ্যাসিস্টদের পুনর্র্বাসন এবং আওয়ামী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্ল্যাক মেইলিং এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন বিপুল অংকের অর্থ। এসব অর্থ তিনি বিদেশে পাচার করেন বলে অভিযোগ উঠে। যে কারণে পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আলী ইমাম মজুমদারকে সরিয়ে দেয়া হয়। দেয়া হয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এরপরে তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব পান। এই দুটি মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা নিজে এবং তার ছেলে টিপু ব্যাপকহারে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন সচিব পদ থেকে মোখলেস-উর-রহমানকে সরিয়ে দেয়া হয় ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরতে ডিসি পদে পদায়ন নিয়ে মোখলেস উর রহমান যে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটান তাতে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারও জড়িত ছিলেন। তিনি তখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহা ক্ষমতাবান কর্মকর্তা। ডিসি নিয়োগের ওই কেলেঙ্কারিতে বহুল আলোচিত ছাত্র সমন্বয়ক গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের নামও ছিল। গাজী সালাউদ্দিন তানভীর ছাত্র সমন্বয়কদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন প্রশাসনে ও সচিবালয়ে। ওই সময়ে এবং পরবর্তী মাসগুলোতেও তানভীরকে সচিবালয়ে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত কাটাতে দেখা গেছে। এই তানভীরকে অনেকবার দেখা গেছে গুলশানে আলী ইমাম মজুমদারের ছেলের তদবির বাণিজ্যের অফিসে। ডিসি পদায়নে ঘুষ কেলেঙ্কারির তদন্তে গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের নাম এসেছে, যদিও সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত জনসমক্ষে প্রকাশ পায়নি। আলী ইমাম মজুমদারের ছেলের নামও এসেছে তদন্তে। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে আলী ইমাম মজমুদারকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এর জবাব দেননি বা দিতে পারেননি।
অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই গুলশানে গ্লোরিয়া জিন্স কফি সপের পাশে তদবির বাণিজ্যের দোকান খুলে বসেন আলী ইমাম মজুমদারের ছেলে মাহমুদুল ইমাম টিপু। ডিসি নিয়োগ বাণিজ্যের অর্থ সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছিল। তারমধ্যে ক্ষমতাধর আলী ইমামের ছেলে টিপুর ভাগে পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে আলী ইমাম মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট ম্যাসেজে। তিনি তখন এ ব্যাপারে কোনোই জবাব দেননি। অনেকটা দ্রুতই তখন টিপুর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। টিপু এ কাজের সুবিধার্থে (তদবিরকারীদের সঙ্গে চুক্তি, লেনদেন প্রভৃতির জন্য) কয়েকজন দালালও নিয়োগ করেন। তারমধ্যে অন্যতম হলেন লেলিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেন দালালের মাধ্যমেই হয়ে আসছে। তবে টিপুর হাতে সরাসরি টাকার বান্ডেল দিয়েছেন এ রকমের নজিরও রয়েছে। সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ প্রতিবেদককে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা সরাসরি টিপুর হাতে টাকা দিয়েছেন।
অবশ্য ঘটনা বেশি মাত্রায় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর টিপু ওই অফিসটিতে এখন আর তেমন একটা বসেন না। বিভিন্ন কফিসপ বা রেস্টুরেন্টে বসেই তিনি কাজকর্ম সারেন। আলী ইমাম মজুমদার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে আউট হওয়ার পরে টিপুর কার্যক্রম এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাদ্য এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অবশ্য অন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী সিন্ডিকেটের কর্মকর্তারা, যাদেরকে আলী ইমাম ‘বিএনপি ঠেকাও’ কর্মসূচির মাধ্যমে বহাল রেখেছেন এরা আলী ইমামের তদবির বা সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করেন এখনো।
শীর্ষনিউজ