Image description

প্রত্নসম্পদ ঘোষণার নয় বছরেও দখলমুক্ত করা যায়নি তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটেবাড়ি। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাড়িটিকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ ঘোষণা করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে বাড়িটি।

১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর ইলা মিত্রের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীন বাংলার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। তাদের আদিনিবাস ছিল ঝিনাইদহের শৈলকুপার বাগুটিয়া গ্রামে। ইলা মিত্র ১৯৪৪ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। বাগুটিয়া গ্রামে অবস্থিত চুন-সুরকিতে নির্মিত ৯ কক্ষবিশিষ্ট কারুকার্যমণ্ডিত বাড়িটির অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখানে বসবাসরত দখলদারদের বাধার মুখে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এখন পর্যন্ত কোনও সাইনবোর্ড স্থাপন করতে পারেনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন এখনও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, জমি অধিগ্রহণ কিংবা বাড়ির বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনও নির্দেশনা আসেনি। এজন্য কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেননি তারা।

১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র। কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তিনি গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার ভূমিকার জন্য ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি হিসেবে স্থান পান।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, বাগুটিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালে ইলা মিত্রের দাদা রাজমোহন সেন বাড়িটি নির্মাণ করেন। ছোটবেলায় গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুরসহ আশপাশের গ্রামে সময় কাটিয়েছেন এই নেত্রী। বাড়িটি এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। সংক্ষরণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 

তারা বলছেন, ইলা মিত্রের পূর্বপুরুষরা ১৯৭০ সালে দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর বাড়িটি দখল হয়ে যায়। শুধু বাড়ি নয়, দখল হয়ে যায় তার বাবার রেখে যাওয়া শত শত বিঘা জমি। বর্তমানে যারা দখলে আছেন; কীভাবে আছেন, তা জানেন না এলাকাবাসী। দেয়ালে ঘেরা প্রাচীরের অনেক অংশ ভেঙে ফেলেছেন দখলদাররা। ইলার বাবার জমিগুলো সরকারের খাতায় ভিপি তালিকাভুক্ত হলেও বাস্তবে প্রভাবশালীদের দখলে।

শৈলকুপা শহর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বাগুটিয়া। পুরোনো আমলের চুন-সুরকির তৈরি ১৭ শতক জমির ওপর দোতলা ও একতলা দুটি ভবন। নয়টি কক্ষ আর একটি প্রধান ফটকযুক্ত বাড়িটিতে বসবাস করছেন মৃত কিয়াম উদ্দিনের চার সন্তান; আলী হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রশিদ ও রাশিদুল ইসলাম। একটি ভবনের ছাদের অনেকাংশ ভেঙে পড়েছে, দেয়ালে ধরেছে ফাটল।

বাড়ির একজন বাসিন্দা আলী হোসেন বিশ্বাসের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, নয়টি কক্ষের প্রাচীন একটি দোতলা বাড়ি এটি। পাঁচটি কক্ষ ব্যবহার করা যায়। তাদের পরিবারের সদস্যরা সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে ১৯৭০ থেকে বসবাস করছেন। বাকি কক্ষগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। 

আবু বক্কর সিদ্দিকের দাবি, বাগুটিয়ার ১১৬নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের জমির ওপর বাড়িটিসহ ৮৪ বিঘা জমি কিনেছেন তার দাদা কিয়াম উদ্দিন। এই সম্পত্তি তার দাদার কাছে বিনিময় সূত্রে বিক্রি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা খোদা বক্স। তার কাছ থেকে ক্রয়মূলে ভোগদখল করছেন তারা। 

আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘১৯৭০ সাল থেকে বাড়িটি নিয়ে ঝামেলা চলছে। বিভিন্ন সময়ে ডিসি-ইউএনও এসে শুধু আশা দিয়ে যান। কিন্তু কাজের কাজ করেন না। বাড়িতে আসার জন্য যে কাঁচা রাস্তা আছে, সেটিও সংস্কারে একটা ইটও ফেলা হয়নি। আমরা বাড়িটি ছেড়ে দিতে রাজি আছি, তবে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের লোকজন শুধু এসে দেখে যান, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেন না।’

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিংবদন্তি ইলার শৈশব কেটেছে বাগুটিয়া, গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুরসহ কয়েকটি গ্রামে। তার বাবা-মায়ের নামে রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি। এগুলো অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি খাতায় থাকলেও বাস্তবে বেদখল। ভূমি অফিস এসব সম্পত্তি উদ্ধারে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেছে। কিন্তু এখনও কোনও সমাধান হয়নি।

ইলা মিত্র ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী নেত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হয়। বারবার দাবি উঠে তার পৈতৃক ভিটা দখলমুক্ত করার। ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও সচেতন নাগরিকরা বাড়িটি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। মানববন্ধন, বিক্ষোভ, স্মারকলিপি পেশসহ নানা উদ্যোগের ফলে ২০১৪ সালে বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে গেজেট প্রকাশিত হয়। এমন নির্দেশনা সত্ত্বেও প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেছে। কালের সাক্ষী ও ঐতিহাসিক স্মৃতিবিড়জিত স্থাপনাটি আজও বেদখল থাকায় প্রশাসনিক গাফিলতিকে দায়ী করছেন এলাকাবাসী। 

ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যসচিব আলমগীর অরণ্য বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার রাজনীতিবিদ ইলা মিত্র। ভারত ও বাংলাদেশ; উভয় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা জীবন মানুষের জন্য লড়াই করলেও আজ নিজের বাড়িসহ জমিজমা অন্যের দখলে। সবকিছু অরক্ষিত পড়ে আছে। বাড়িটির বর্তমান বাসিন্দাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করে ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটাবাড়ি সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।’ 

একই দাবি জানালেন ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুর রহমান মিল্টন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তা উপেক্ষা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অবিলম্বে বাড়িটি দখলমুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যসচিব সুজন বিপ্লব বলেন, ‘এই বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের ইতিহাস। স্মৃতিরক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করতে এটি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।’

সিপিবির ঝিনাইদহ জেলার সাধারণ সম্পাদক আবু তোয়াব অপু বলেন, ‘বাড়িটি সংরক্ষণ, নাচোল কৃষক আন্দোলনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশসহ বিচারিক রায়কে অবৈধ ঘোষণা, পাঠ্যপুস্তকে তার জীবনী সংযোজন, ইলা মিত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কেসি কলেজ ছাত্রীনিবাস ও সড়ক নামকরণের গণদাবি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচি ডাকা হয়েছে।’

বাগুটিয়ার জরিপ বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের ঘোষণার প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও একটা সাইনবোর্ড পর্যন্ত দিতে পারেনি প্রশাসন। বাড়িটি অরক্ষিত থাকার জন্য দায়ী স্থানীয় প্রশাসন। তাদের গাফিলতির কারণে দখলমুক্ত হয়নি।’

এ ব্যাপারে শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস বলেন, ‘বাড়িটিতে বর্তমানে যারা বসবাস করছেন তাদের দাবি তারা সম্পদটি কিনে নিয়েছেন। তাদের পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশের পর জমি অধিগ্রহণের পরবর্তী কোনও নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো আমরা।’

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল বলেন, ‘২০১৭ সালে বাড়িটি সংরক্ষণে গেজেট প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও নির্দেশনা দেয়নি। যে কারণে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়িটি পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ সালে গেজেট প্রকাশের পর সেখানে সাইনবোর্ড টানাতে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু বাধার মুখে ফিরে এসেছি। তাই আর কার্যক্রম এগোয়নি। আমরা জেলা প্রশাসনের কথা বলে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো।’

বিপ্লবী ইলা মিত্রের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হলো ১৮ অক্টোবর। এ উপলক্ষে ইলা মিত্রের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তারা শোভাযাত্রা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেছেন শনিবার। শহরের ফায়ার সার্ভিস মোড় থেকে সকাল সাড়ে ১০টায় শোভাযাত্রা বের হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর পার্কে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে বাড়িটি সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হয়।