
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (সিইপিজেড) শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের আটটি কারখানা গত চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্র্তৃপক্ষ (বেপজা) শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে। তবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় কারখানা কর্র্তৃপক্ষ উৎপাদন শুরুর ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
পুলিশ বলছে, ‘তাদের ধারণা কারখানাগুলোয় অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে তৃতীয় পক্ষের প্ররোচনা রয়েছে। ঘটনার দিন তিন শ্রমিকের মৃত্যুর “ভুয়া ভিডিও” ছড়িয়ে শ্রমিকদের উত্তেজিত করার তথ্য পাওয়া গেছে।’
পুলিশ ও বেপজা সূত্রে জানা গেছে, গত বছর গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় শিল্প পুলিশের দায়ের করা একটি মামলাকে কেন্দ্র করে গত ১৪ অক্টোবর প্যাসিফিক জিন্সের শ্রমিকরা হঠাৎ কাজে যোগ না দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তারা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ১৫ অক্টোবর বেপজা ও পুলিশ কর্মকর্তারা শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিরীহ কাউকে হয়রানি না করার আশ্বাস দেন। এরপর ১৬ অক্টোবর অধিকাংশ শ্রমিক কাজে ফিরলেও একটি অংশ কাজে যোগ দেয়নি। এ সময় তিন শ্রমিকের মৃত্যুর একটি ভুয়া ভিডিও প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের সব কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে উত্তেজিত শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে বাধা দেয় এবং কারখানা ত্যাগের জন্য সহকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে শ্রমিকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও সব কারখানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন সন্ধ্যায় প্যাসিফিক জিন্স কর্র্তৃপক্ষ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য আটটি কারখানা বন্ধের নোটিস জারি করে।
বন্ধ কারখানাগুলো হলো, প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড, প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড (ইউনিট-২), প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স লিমিটেড, প্যাসিফিক অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, এনএইচটি ফ্যাশনস লিমিটেড, জিন্স ২০০০ লিমিটেড, ইউনিভার্সাল জিন্স লিমিটেড এবং প্যাসিফিক ওয়ার্কওয়ার্স লিমিটেড। এসব কারখানায় প্রায় ৩২ হাজার শ্রমিক কর্মরত। বন্ধের ঘোষণার পর শ্রমিকরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। পুলিশ ও বেপজা কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পর শান্তিপূর্ণভাবে কাজে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হলেও একটি অংশের কাজে না ফেরা এবং ভুয়া ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় অস্থিরতা তৈরি হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্তে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। প্রচারিত তিন শ্রমিকের মৃত্যুর ভিডিওটি পুরোপুরি ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে। যাদের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তারা সবাই সুস্থ রয়েছেন।
পুলিশের ধারণা, তৃতীয় পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে কাজ করছে। চট্টগ্রামের শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের তদন্তে দেখা গেছে, এই সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক মৃত্যুর ভুয়া ভিডিও ছড়িয়েছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দোষীদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
তিনি জানান, গত জানুয়ারিতে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। মামলাটি তদন্তাধীন এবং এতে কাউকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করার কোনো নজির নেই। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলেছি, সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হবে না।’
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বেপজার সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। ভুয়া ভিডিওর মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি শ্রমিকরা বুঝতে পেরেছেন এবং কাজে ফিরতে চান। আমরা দ্রুত অচলাবস্থা কাটিয়ে কারখানা চালুর চেষ্টা করছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুজব ছড়ানো ও অস্থিরতা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তাদের গতিবিধির ওপর কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে। অনেক শ্রমিক ফেসবুকে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ছবি পোস্ট করেছেন। কেউ কেউ কারখানা খোলার আকুতি জানিয়ে কর্র্তৃপক্ষের কাছে খোলা চিঠি লিখছেন।
সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কারখানা চালু করা এবং শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা দূর করা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও কাজের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে জোর দিচ্ছি। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করি, দ্রুত কারখানাগুলো চালু করতে পারব।’
প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে কর্র্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, শ্রমিকদের আন্দোলনের ইস্যু পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যকার বিষয়। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানের। তাই অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হলে কারখানা খোলার ঝুঁকি নিতে চায় না কর্র্তৃপক্ষ।