
পূর্বাচল নতুন শহরকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি পূর্বাচল শহরের জন্য ৪টি থানা, ৬টি ফাঁড়ি ও ৪১টি পুলিশ বক্স চালু করতে জনবল চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সেই প্রস্তাব যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
পূর্বাচল নতুন শহরে বরাদ্দ পাওয়া প্লটমালিকেরা বলছেন, তাঁরা পূর্বাচলে নিজ জমিতে বাড়িঘর তুলে থাকতে চান। কিন্তু থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চালু না হওয়ায় নিরাপত্তার অভাবে তাঁরা সেখানে বাড়ি নির্মাণ করতে ভয় পাচ্ছেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সম্প্রতি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে পূর্বাচল নতুন শহরে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চালু করার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল চালু হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বিশাল আয়তনের হওয়ায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য থানা, ফাঁড়ি, পুলিশ বক্স ও পুলিশ লাইনসসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে এই প্রকল্পের মোট আয়তন প্রায় ৬ হাজার ২১৪ একর। সেখানে ২৬ হাজার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই এলাকা ডিএমপির বাড্ডা ও খিলক্ষেত থানা, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে পুলিশ বিভাগের স্থাপনা নির্মাণের জন্য বিভিন্ন আকৃতির প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যাতে জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ একর। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বিশাল আয়তনের হওয়ায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য থানা, ফাঁড়ি, পুলিশ বক্স ও পুলিশ লাইনসসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটির উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হবে। প্লটের মালিকেরাও বসতি গড়ে তুলবেন।
রাজউক ও ডিএমপি সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য একটি সামগ্রিক পুলিশ নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিএমপির আওতাধীন নতুন ১টি অপরাধ বিভাগ, ১টি গোয়েন্দা বিভাগ, ১টি ট্রাফিক বিভাগ, ১টি পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ (পিওএম), ১টি পরিবহন বিভাগ, ১টি পুলিশ লাইনস, ২টি অপরাধ অঞ্চল (জোন), ৪টি থানা, ৬টি ফাঁড়ি ও ৩০টি পুলিশ বক্স করা হবে। এ জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সব স্থাপনার জন্য মোট ৭ হাজার ৩২৫ জনের জনবলকাঠামো চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি পূর্বাচল প্লট মালিক সমিতির নেতারা পূর্বাচল নতুন শহরে নিরাপত্তার জন্য থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চেয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স স্থাপন ও এর জন্য জনবল চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ডিএমপি।অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মো. সরওয়ার
প্রস্তাবিত পূর্বাচল বিভাগ নামের অপরাধ বিভাগের প্রধান হিসেবে থাকবেন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রস্তাবিত ৪টি থানা, ৬টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ৪১টি পুলিশ বক্স পরিচালিত হবে। থানাগুলো হলো ব্রাহ্মণখালী, পশি, বরকাউ ও পারাবাথা। প্রতিটি থানার জন্য ৩ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৩৪ উপপরিদর্শক (এসআই), ২৮ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ৩৯ জন পুলিশ কনস্টেবলসহ মোট ১০৪ জন পুলিশ সদস্য থাকবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ৬ পুলিশ ফাঁড়ি হলো ইউসুফগঞ্জ, বিন্দু, চাণক্য, পূর্বাশা, কামতা ও গুতিয়াবো। প্রতিটি পুলিশ ফাঁড়িতে ২ জন এসআই, ৪ জন এএসআই, ২০ জন কনস্টেবলসহ মোট ২৬ জন পুলিশ সদস্য এবং প্রতিটি পুলিশ বক্সের জন্য ১ জন এসআই, ২ জন এএসআই, ৬ জন পুলিশ কনস্টেবলসহ মোট ৯ জন পুলিশ সদস্য দরকার।
পূর্বাচলের বিশাল এলাকা অরক্ষিত থাকায় খুন করে লাশ ফেলে যায় অপরাধীরা। নিরাপত্তার অভাবে মানুষ সেখানে বসবাস করতে ভয় পান। পূর্বাচলে থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চালু হলে মানুষ সেখানে বাড়িঘর তুলে বসবাস করবে। তখন ঢাকা শহরের যানজটও কমে যাবে।ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মো. সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি পূর্বাচল প্লট মালিক সমিতির নেতারা পূর্বাচল নতুন শহরে নিরাপত্তার জন্য থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চেয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স স্থাপন ও এর জন্য জনবল চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ডিএমপি। সেখান থেকে এই প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
ডিএমপির প্রস্তাবে পূর্বাচল অপরাধ বিভাগ ও দাঙ্গা দমন বিভাগ (পূর্বাচল) সৃষ্টির বিষয়ে নানা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বাচলের বিশাল এলাকা অরক্ষিত থাকায় খুন করে লাশ ফেলে যায় অপরাধীরা। নিরাপত্তার অভাবে মানুষ সেখানে বসবাস করতে ভয় পান। পূর্বাচলে থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স চালু হলে মানুষ সেখানে বাড়িঘর তুলে বসবাস করবে। তখন ঢাকা শহরের যানজটও কমে যাবে।
সরেজমিন
পূর্বাচলে ৫ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, সেখানের বিভিন্ন সেক্টরে কিছু মানুষ বসবাস করতে শুরু করেছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করা হয়েছে। কিছু সেক্টরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য খুঁটি বসেছে এবং পানির লাইন করার জন্য পাইপ রাখা হয়েছে। এর আগে সব সেক্টরের রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। হ্রদের ওপর বসেছে সেতু।
পূর্বাচল ২৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বাচল অপরাধ বেশি। পুলিশের থানা না থাকায় সেখানে চুরি, ছিনতাই ও খুন হচ্ছে।
প্লট বরাদ্দ পাওয়া অনেকে বাড়ি করার কথা ভাবছেন। কিন্তু নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে পারছেন না। তাঁদের একজন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদ-উল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বাচলে থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি চালু হলেই বাড়িঘর করে সেখানে থাকতে শুরু করবেন তিনি।
স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত
রাজউক সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাস্তবায়ন মেয়াদকাল শেষে নগর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে অনুষ্ঠিত একাধিক আন্তমন্ত্রণালয় নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম।
সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়। তার মধ্যে রয়েছে পূর্বাচল নতুন শহরে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে। এর আগে আটটি গাড়িতে ১০০ সশস্ত্র আনসার দিয়ে টহল চালু রাখবে রাজউক। আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় মাধ্যমিক স্কুলের জন্য বরাদ্দ করা জায়গায় কবরস্থান রয়েছে। সেখানে খেলার মাঠ ও স্কুল ভবনের ওরিয়েন্টেশন প্রয়োজনে পরিবর্তন করে দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় মোট ১১টি প্লটে দ্রুত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করতে হবে।
পূর্বাচলে ২৬ নম্বর সেক্টরে প্রস্তাবিত রাজউক পূর্বাচল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রকল্পের অধীনে একাডেমিক ভবনটি সাততলার পরিবর্তে বহুতল করার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। এতে আরও বলা হয়, পূর্বাচলে নির্ধারিত প্লটে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণে রাজউককে পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্বাচলকে ডিএনসিসির অন্তর্ভুক্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। এ ছাড়া পূর্বাচলে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ করবে।
সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়। তার মধ্যে রয়েছে পূর্বাচল নতুন শহরে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে। এর আগে আটটি গাড়িতে ১০০ সশস্ত্র আনসার দিয়ে টহল চালু রাখবে রাজউক। আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় মাধ্যমিক স্কুলের জন্য বরাদ্দ করা জায়গায় কবরস্থান রয়েছে।
রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মো. ইকবাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক মো. আবদুল বাসেত প্রথম আলোকে জানান, পূর্বাচলে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে জমি দলিল করে দেওয়া হয়েছে। পূর্বাচলকে ডিএনসিসির অন্তর্ভুক্ত করতেও চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাচলে কিছু মানুষ বসবাস শুরু করেছে। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান
‘এত দিনে কেন হলো না’
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। যদিও প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে এখন পর্যন্ত ৪৬০টি ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভবন করা হয়েছে ৯০টি। ৭৭টির নির্মাণকাজ চলছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এত দিনেও নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অবকাঠামোর মতো নাগরিক সুবিধা কেন হলো না? অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব সেবা চালু করতে হবে। তিনি বলেন, পূর্বাচলে কিছু মানুষ বসবাস শুরু করেছে। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।