Image description

ব্রাজিল বাড়ির কথা মনে আছে? নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ছয়তলা এই বাড়ির পুরোটাই আঁকা ব্রাজিলের পতাকা। ফলকে লেখা নাম ‘ব্রাজিল বাড়ি’। ২০১৮ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ চলার সময় বাড়িটিতে গিয়েছিলেন ঢাকায় ব্রাজিলের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা ডি অলিভেরিয়া জুনিয়র।

ব্রাজিল বাড়ির মালিক যমুনা তেল কোম্পানির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জয়নাল আবেদীন ওরফে টুটুল। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি জ্বালানি তেল চুরিসহ দুর্নীতি এবং অবৈধ আয়ে জমি, ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

জয়নাল এক দশক ধরে যমুনা অয়েল কোম্পানি লেবার ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি। ইউনিয়নের কার্যালয় শুধু চট্টগ্রামে। কিন্তু তিনি ফতুল্লার ডিপোতে ইউনিয়নের নামে নিজের একটি কার্যালয়ও তৈরি করেছেন। বিগত সরকারের সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ হন তিনি। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পরও আড়াল থেকে ডিপো নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ আছে। এখন তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন।

যমুনা তেল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা গত মার্চে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জয়নালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এতে বলা হয়, জুলাই আন্দোলনে খুনের মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন জয়নাল। তবে অফিসে ঠিকই তাঁর নামে হাজিরা দেখানো হচ্ছে। কোম্পানি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

উল্লেখ্য, খাতায় সইয়ের মাধ্যমে যমুনায় হাজিরা নেওয়া হয়।

ব্রাজিল বাড়ির মালিক যমুনা তেল কোম্পানির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জয়নাল আবেদীন ওরফে টুটুল। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি জ্বালানি তেল চুরিসহ দুর্নীতি এবং অবৈধ আয়ে জমি, ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জয়নালের ব্রাজিল বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ২ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি সেভাবেই পড়ে আছে। মেরামত করা হয়নি। কেউ বসবাসও করেন না।

পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা—সরকারি এই তিন তেল কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে ভুয়া হিসাব দেখিয়ে জ্বালানি তেল চুরি করে বিক্রির একটি চক্র তৈরি হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত এ চক্রে। এর মূলে আছেন জয়নালের মতো তেল কোম্পানির শ্রমিক সংগঠনের (সিবিএ) কয়েকজন নেতা, যাঁরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর অধীনে নিজস্ব পরিবেশকদের মাধ্যমে বাজারে তেল বিক্রি করে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। সিবিএ সংগঠনগুলো গত দেড় দশক জাতীয় শ্রমিক লীগের অংশ ছিল। গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর সংগঠনগুলো জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের দিকে ঝুঁকেছে। সংগঠনের শীর্ষ নেতারা নিয়মিত অফিসও করেন না।

পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা—সরকারি এই তিন তেল কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে ভুয়া হিসাব দেখিয়ে জ্বালানি তেল চুরি করে বিক্রির একটি চক্র তৈরি হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত এ চক্রে।

তেল কোম্পানিগুলোর প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে। জ্বালানি তেল চুরি ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে ২ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। এতে তেল কোম্পানির সিবিএর অন্তত চারজন নেতার বিলাসী জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বছরে শত শত কোটি টাকার তেল চুরির বাণিজ্য হলেও কাগজে–কলমে প্রমাণ করা কঠিন। সাধারণত তেল চুরি হয় দুভাবে। প্রথমত, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে তেল পরিমাণে বেড়ে যায়। এই বাড়তি তেল হিসাবে দেখানো হয় না। চুরি করা হয়। দ্বিতীয়ত, তেলের একাংশ বিক্রি করে তা ভেজাল মিশিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়। তেলের চাহিদা ও বিক্রির হিসাবের গরমিল থেকে বিষয়টি স্পষ্ট।

তেল চুরি হয় দুভাবে

  • উচ্চ তাপমাত্রার কারণে তেল পরিমাণে বেড়ে যায়। চুরি করা হয়।

  • তেলের একাংশ বিক্রি করে তা ভেজাল মিশিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়।

তেল চুরির বিষয়টি এ চক্রে জড়িত ব্যক্তিদের বিলাসী জীবনযাপন থেকেও উঠে আসে। যমুনা তেল কোম্পানির দুই শ্রমিকনেতা জয়নাল ও মোহাম্মদ এয়াকুবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে ৮ অক্টোবর দুটি আলাদা কমিটি করেছে বিপিসি।

জ্বালানি তেল চুরি ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে ২ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। এতে তেল কোম্পানির সিবিএর অন্তত চারজন নেতার বিলাসী জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে।
জয়নাল আবেদীন ও মুহাম্মদ এয়াকুব
জয়নাল আবেদীন ও মুহাম্মদ এয়াকুব

তেল মেপে ‘ব্রাজিল বাড়ির মালিক’

তেল কোম্পানিগুলো সারা দেশে ডিপোর মাধ্যমে ডিলারদের কাছে তেল সরবরাহ করে। সারা দেশে এমন ডিপো আছে ৪৭টি। এর মধ্যে শুধু যমুনার ডিপো ১৫টি। তেল কোম্পানি যমুনার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপোতে দারোয়ানের চাকরি করতেন জয়নালের বাবা মো. রফিক। তাঁর মৃত্যুর পর ক্যানটিনের কর্মচারী হিসেবে ‘কাজ নাই, বেতন নাই’ ভিত্তিতে চাকরি পান জয়নাল। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ কর্মী হিসেবে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। অল্প সময়েই তিনি হয়ে যান গেজার (যাঁর কাজ তেল মাপা)।

যমুনার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, তেল মাপার মধ্যে আছে হিসাবের বড় ফাঁকি; যা কাজে লাগিয়ে জয়নাল বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সূত্র বলছে, গত আগস্টের হিসাবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জয়নালের মূল বেতন ২০ হাজার ৩১০ টাকা। ভাতা, সুযোগ-সুবিধাসহ সব মিলে বেতন ৫০ হাজার ৫০০ টাকা।

জয়নাল মুঠোফোনে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁর ঢাকায় কোনো ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই। ভাইবোনদের সহযোগিতা, খুলনায় বাবার (ফরিদ মোটরস) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয় ও পেনশন এবং ব্যাংকঋণের টাকা দিয়ে ব্রাজিল বাড়ি বানানো হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ এবং ফতুল্লা ডিপো ও যমুনা তেল কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, জয়নাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে জমি ও ফ্ল্যাট আছে। ফতুল্লায় রয়েছে ব্রাজিল বাড়ি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ব্রাজিল বাড়ির জমি জয়নালের বাবার কেনা। জমির পরিমাণ ৪ শতাংশ। সেই জমিতে দেড় দশক আগে দুই ইউনিটের ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন জয়নাল। বাড়িটি তৈরিতে দেড় কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয় মানুষের।

জয়নাল মুঠোফোনে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁর ঢাকায় কোনো ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই। ভাইবোনদের সহযোগিতা, খুলনায় বাবার (ফরিদ মোটরস) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয় ও পেনশন এবং ব্যাংকঋণের টাকা দিয়ে ব্রাজিল বাড়ি বানানো হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, যমুনা অয়েলের তেল লোপাট বা চুরিসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তাঁর নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। তাই কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করে নিয়মিত অফিস করেন।

অবশ্য যমুনা অয়েলের দুজন কর্মকর্তা বলেন, জয়নালের বাবা ফতুল্লায় চাকরি করতেন, বাড়ি নোয়াখালী। খুলনায় কীভাবে তাঁর ব্যবসা থাকে? যমুনার চাকরিজীবী হিসেবে তাঁর ব্যবসা করার সুযোগ নেই। পেনশন হিসেবে ওই সময় একজন কর্মচারী বড়জোর এক লাখ টাকা পেয়ে থাকতে পারেন।

ব্রাজিল বাড়ির পাশেই জয়নালের নিজের কেনা ৫ শতাংশ জমিতে আরও একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, ওই বাড়িতে জয়নালের বক্তিগত অফিস রয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর ওই বাড়িও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখানে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

জয়নালের তিন বোন ও দুই ভাই। তিন বোনের তিন স্বামীর মধ্যে দুজন এখন ফতুল্লায় যমুনার ডিপোতে চাকরি করেন, একজন স্থায়ী কর্মচারী ও আরেকজন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। তাঁর আরেক ভগ্নিপতি ও ছোট ভাই ব্যবসা (জয়নাল ও নিজেদের) দেখাশোনা করেন। তাঁদেরসহ আত্মীয়স্বজনের নামে জয়নালের সম্পদ আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ব্রাজিল বাড়ির নামে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিলেও তিনি তা এক বছরের মধ্যে শোধ করে দিয়েছেন। ঋণ নিয়েছিলেন মূলত বাড়ি করার টাকার বৈধ উৎস দেখাতে। দুদক তদন্ত করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

এদিকে ব্রাজিল বাড়ির পাশেই জয়নালের নিজের কেনা ৫ শতাংশ জমিতে আরও একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, ওই বাড়িতে জয়নালের বক্তিগত অফিস রয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর ওই বাড়িও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখানে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য জয়নালের দুটি জাহাজ ও দুটি ট্যাংক–লরি আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি নিজে চড়েন প্রিমিও মডেলের গাড়িতে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এই গাড়ি জয়নালের স্ত্রীর নামে নিবন্ধিত। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে গাড়িটি নিবন্ধন করা হয়।

জয়নালের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চর কুতুবপুরের মধ্য আবদুল্লাহপুর এলাকায়। ৬ অক্টোবর সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। তাঁরা বলেন, পারিবারিকভাবে তাঁদের তেমন কিছুই ছিল না। গত কয়েক বছরে এলাকায় জয়নালের জমিজমার পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মানুষজনকে সাহায্য করার প্রবণতাও।

জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য জয়নালের দুটি জাহাজ ও দুটি ট্যাংক–লরি আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি নিজে চড়েন প্রিমিও মডেলের গাড়িতে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এই গাড়ি জয়নালের স্ত্রীর নামে নিবন্ধিত। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে গাড়িটি নিবন্ধন করা হয়।

জয়নালের গ্রামের বাড়িতে একটি একতলা পাকা ভবন দেখা গেছে। এটিতে থাকেন জয়নালের চাচা। গ্রামে এলে জয়নাল অবশ্য এই বাড়িতেই থাকেন। তাঁর জন্য একটি এসি (শীতাতপনিয়ন্ত্রিত) রুম আছে বাড়িতে। ভবনের পাশে একটি গ্যারেজ বানানো হয়েছে। বাড়ি এলে এ গ্যারেজে থাকে জয়নালের গাড়ি। বাড়ির পেছনে এক একর জমিতে একটি নতুন পুকুর খনন করেছেন জয়নাল। পুকুরের চারপাশ দৃষ্টিনন্দন করার জন্য বসানো হচ্ছে ঢালাই করা স্ল্যাব। বসানো হয়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ বেশ কয়েকটি বাতি।

পুকুরের চারপাশে, বাড়ির প্রবেশপথে, বসতঘরের আশপাশে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। ঢাকায় বসে মুঠোফোনে সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরার সাহায্যে বাড়ির সবকিছু জয়নাল দেখভাল করেন বলে জানা গেছে স্বজনদের কাছে।

অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়নালের এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, জয়নাল কী এমন চাকরি করেন, সে হিসাব তাঁরা মেলাতে পারেন না। বাড়ি ও পুকুরপাড়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন তিনি। এলাকায় দান করছেন। এত টাকা কোথা থেকে আসছে, প্রশ্ন তাঁর।

জয়নালের ভগ্নিপতি মো. কামাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শ্বশুর মারা যাওয়ার পর তাঁর শ্যালক জয়নাল যমুনা অয়েলে চাকরি পান। চাকরি করে তিনি বাড়িতে টুকটাক জমি কিনেছেন। চাকরি ছাড়াও তাঁর জয়নালের জাহাজের ব্যবসা আছে। দুটি বাল্কহেডের মালিক তিনি। তিনি (ভগ্নিপতি) নিজেও দুটি জাহাজের মালিক। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে জমানো টাকায় তিনি জাহাজের ব্যবসা করছেন বলে দাবি করেন। উল্লেখ্য, সরকারি তেল কোম্পানিতে চাকরি করে ব্যবসা করার সুযোগ নেই।

জয়নালদের বাড়ির সামনেই নির্মিত হচ্ছে একটি দ্বিতল মসজিদ। জয়নাল দাবি করেছেন, দানের টাকায় মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। তবে এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, মসজিদটি নির্মাণে প্রায় কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার প্রায় পুরোটা দিচ্ছেন জয়নাল।

অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়নালের এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, জয়নাল কী এমন চাকরি করেন, সে হিসাব তাঁরা মেলাতে পারেন না। বাড়ি ও পুকুরপাড়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন তিনি। এলাকায় দান করছেন। এত টাকা কোথা থেকে আসছে, প্রশ্ন তাঁর।

নতুন উপায়ে তেল চুরি, ‘যোগসাজশ’ জয়নালের

জ্বালানি তেল চুরি ও অপচয় রোধে ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন নির্মাণ করেছে সরকার। এ পাইপলাইনে তেল সরবরাহ চালু হয়েছে গত জুনে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় মূল টার্মিনাল থেকে সরাসরি তেল আসছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। এর মধ্যেও যমুনা তেল কোম্পানির ডিপোয় দুই দফায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার লিটার ডিজেল ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়। এ ঘটনার সঙ্গে টুটুলের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ আছে।

তেল গায়েবের বিষয়টি ইতিমধ্যে আমলে নিয়েছে যমুনা অয়েল কোম্পানি। ঘটনা তদন্ত করতে একটি কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য যমুনা অয়েল কোম্পানির এজিএম (ইএন্ডডি) মো. আলমগীর আলম ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ফতুল্লা পরিদর্শন করেছেন। সবকিছু যাচাই–বাছাই করে দেখছেন।

১ অক্টোবর ফতুল্লা ডিপোর তেল চুরি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। তেল চুরি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে ৬ অক্টোবর একটি কমিটি করেছে জ্বালানি বিভাগ। একই ঘটনা তদন্তে কমিটি করেছে বিপিসি। দুদকও অভিযান শুরু করেছে।

বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেল খাতের অভিযোগ দূর করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তেল চুরি নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পদের বিষয়ও যাতে উঠে আসে, সেটি কমিটিকে বলা হয়েছে। এরপর এসব তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেওয়া হবে। নির্বাচিত সিবিএ নেতাদের বদলি করার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা আছে। তাই প্রয়োজনে শ্রম আইন সংশোধন করে তাঁদের বদলির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

যমুনার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, তিন বছর চুক্তিতে কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে চাকরি স্থায়ী হওয়ার সময় এয়াকুবের মূল বেতন ছিল ৯৩৫ টাকা। এখন এটি বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০৩ টাকা। সব মিলে বেতন এখন ৮৫ হাজার ১০০ টাকা।

টাইপিস্ট থাকেন ৪ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে

মো. আবুল কাশেম ছিলেন যমুনা তেল কোম্পানির অফিস সহায়ক। তাঁর মৃত্যুর পর টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি পান সন্তান মুহাম্মদ এয়াকুব। ২০০৯ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানির লেবার ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন এয়াকুব। এক বছর পর হন সাধারণ সম্পাদক। সেই থেকে তিনি এই পদে রয়েছেন। গত দেড় দশক এটি ছিল শ্রমিক লীগের সংগঠন। গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি এটিকে শ্রমিক দলের সংগঠন বানিয়েছেন।

যমুনার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, তিন বছর চুক্তিতে কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে চাকরি স্থায়ী হওয়ার সময় এয়াকুবের মূল বেতন ছিল ৯৩৫ টাকা। এখন এটি বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০৩ টাকা। সব মিলে বেতন এখন ৮৫ হাজার ১০০ টাকা।

তবে এ বেতনের ছাপ নেই এয়াকুবের জীবনযাপনে। চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা খুলশীতে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকেন। নামে-বেনামে তাঁর বিনিয়োগ আছে বিভিন্ন ব্যবসায়। চড়েন মাইক্রোবাস নোয়াহতে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, ২০১৯ মডেলের এ গাড়ি গত বছরের মার্চে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তির নামে নিবন্ধন করা হয় চট্টগ্রামে। যমুনা সিবিএ সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীর হলেন এয়াকুবের বন্ধু। জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে কল করে সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রথম আলোর হাতে কিছু বায়না দলিলের কাগজ এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ২১ লাখ টাকায় ৬ শতাংশ জমি কিনেছেন এয়াকুব। ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ এলাকায় নুরুন নাহার বেগমের সঙ্গে যৌথভাবে ৫০ লাখ টাকায় ৪ শতাংশ জমি কেনেন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম।

দুদক সূত্র বলছে, এয়াকুবের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে বেশ কিছু সম্পদের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। বোয়ালখালী উপজেলায় ১৪ শতাংশ, সাড়ে ১১ শতাংশ ও ১২ শতাংশের তিনটি জমি পাওয়া গেছে। আরও কিছু জমি আছে যৌথভাবে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় খুলশীর দামপাড়ায় ৪ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে তাঁর। দলিলে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা দাম পাওয়া গেছে ফ্ল্যাটের।

যমুনার পার্বতীপুর ডিপোতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের কাজ করেন এয়াকুবের ভাই আইয়ুব। তাঁর নামেও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাটসহ সম্পদ আছে বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন ডিপো মিলে এয়াকুবের অন্তত ২৬ জন আত্মীয় কাজ করেন যমুনায়। মুহাম্মদ এয়াকুবের দুটি মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রথম আলোর হাতে কিছু বায়না দলিলের কাগজ এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ২১ লাখ টাকায় ৬ শতাংশ জমি কিনেছেন এয়াকুব। ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ এলাকায় নুরুন নাহার বেগমের সঙ্গে যৌথভাবে ৫০ লাখ টাকায় ৪ শতাংশ জমি কেনেন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম।

দুদকে আরও অভিযোগ, অনুসন্ধান ও মামলা

জ্বালানি তেল খাতের কর্মকর্তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে চট্টগ্রাম দুদকে। তদন্ত চলছে। তিন তেল কোম্পানির আলোচিত সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করছে দুদক। তবে এসব তদন্তে বছরের পর বছর সময় চলে যায়। অভিযোগ দাখিলের প্রায় ছয় বছর পর পদ্মা তেল কোম্পানির সিবিএ নেতা মো. নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা করেছে দুদক। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়ার কথা বলছে দুদক।

মামলার এজাহারে বলা হয়, নাছির ২ কোটি ১১ লাখ টাকার সম্পদ গোপন ও ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তাঁর নামে জমি ও কমিউনিটি সেন্টার পাওয়া গেছে। এ নিয়ে তিনি তথ্য গোপন করেছেন।

মেঘনা তেল কোম্পানির সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মো. হামিদুর রহমানের বিরুদ্ধে তেল চুরি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। তেল কোম্পানি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিপোর কর্মচারীরা প্রতি মাসে বেতনের বাইরে একটি ভাতা পান সিবিএ নেতাদের কাছ থেকে। এ ছাড়া সিবিএ নেতাকে সহায়তা করে তেল চুরির বাণিজ্যে ভাগ বসান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও। তাঁদের মধ্যে ডিপো থেকে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের কেউ কেউ জড়িত আছেন। চুরির ভাগ বিপিসির কর্মকর্তাদের হাতেও চলে যায়।

জ্বালানি তেল কোম্পানি ও বিপিসি খুবই অস্বচ্ছ। কোনো নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ নেই। আইএমএফ আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার কথা বলেছে, সেটা করা হয়নি। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রির পুরো প্রক্রিয়া তদন্ত করে দেখা উচিত, আগের কোনো সরকার এটি করেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম

‘বেতন–ভাতা দিয়ে তো এত সম্পদ হয় না’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, তেল চুরি এবং কোনো কোনো সিবিএ নেতা ও কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধান চালালেই বিস্তারিত চিত্র বেরিয়ে আসবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেল কোম্পানি ও বিপিসি খুবই অস্বচ্ছ। কোনো নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ নেই। আইএমএফ আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার কথা বলেছে, সেটা করা হয়নি। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রির পুরো প্রক্রিয়া তদন্ত করে দেখা উচিত, আগের কোনো সরকার এটি করেনি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। বেতন–ভাতা দিয়ে তো এত সম্পদ হয় না।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী ও মজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ]