
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানস্থল থেকে জুলাইযোদ্ধাসহ বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুরে জড়িতদের লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় জুলাই যোদ্ধাদের সাথে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দেখা গেছে। প্রায় তিন ঘণ্টা তারা পুরো সংসদ ভবন এলাকায় হামলা, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। বিকেল তিনটার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় সেনা বাহিনীর সদস্যদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখা গেছে। সংঘর্ষের সময় পুলিশসহ ৪০জন আহন হয়। আহতদের মধ্যে ১০ জনকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়েছে। তবে ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে মঞ্চের সামনে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগই একই রঙের পোশাক ও টুপি পরেছিলেন। তবে সংঘর্ষের সময় সাধারণ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভাঙচুর ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িতদের প্রতিহত করেন।
অন্যদিকে, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে বিক্ষোভ করেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। তারা বলেন, এই সনদ তারা মেনে নেবেন না। কারণ, এতে জুলাই আন্দোলনে আহতদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এ সময় যোদ্ধাদের ওপর হামলার বিচার দাবি করেন তারা। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শতাধিক জুলাইযোদ্ধা মিছিল নিয়ে সংসদ ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের প্রবেশে বাধা দেয়। পরে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন নেতারা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই জুলাই সনদ সংশোধনসহ তিন দফা দাবিতে সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থান করছিলেন জুলাই যোদ্ধারা। শুক্রবারও দাবি আদায়ে ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’র ব্যানারে শতাধিক মানুষ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান নেন। এ সময় ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ ছত্রছায়ায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের করে। এক পর্যায়ে পুলিশ দুপুর সোয়া ১টার দিকে মঞ্চের সামনে থেকে জুলাইযোদ্ধাসহ অন্যান্যদের সরিয়ে দেয়। ওই সময় কয়েকজনকে লাঠিপেটাও করতে দেখা যায়। এ ঘটনায় জুলাই যোদ্ধাদের কয়েকজন আহত হলে তাদের হাসপাতালে নিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে জুলাইযোদ্ধারা অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে এসে বিক্ষোভের পাশাপাশি কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। একই সময় একদল ব্যক্তি আবারও মঞ্চের দিকে ঢুকে গেলে পুলিশ ফের তাদের সরিয়ে দেয়।
থমথমে এই পরিস্থিতির মধ্যেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের কয়েকটি জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে সংসদ ভবন সংলগ্ন আসাদগেট এলাকায় কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরবর্তীতে দুপুর আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে খামারবাড়ি মোড়ের দিকে এবং আরেকটি দলকে আসাদ গেটের দিকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শুক্রবার সকালে ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে দক্ষিণ প্লাজায় অবস্থান নেন বিক্ষুব্ধ জুলাইযোদ্ধারা। তাদের অভিযোগ, জুলাই সনদে তাদের ভূমিকা ও ত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, বরং সনদটি আইনি ভিত্তিহীন ও অবমূল্যায়নমূলকভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। রাত থেকেই সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থান নেওয়া কয়েকশত আন্দোলনকারী সকাল গড়াতেই প্রবেশের চেষ্টা করেন মূল ভবনের দিকে। কেউ কেউ গ্রিল টপকে সামনে এগিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত মূল ফটক খুলে দেয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তাকর্মীরা এবং বিক্ষুব্ধ যোদ্ধা অনুষ্ঠানস্থলের মূল মঞ্চ ও অতিথিদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে পড়েন। এ সময় বহিরাগতদের দেখা গেছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ জানান, বিক্ষোভের একপর্যায়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ছাড়াও পুলিশের ওপর হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের পাঁচটি যানবাহন ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে আসেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ। তিনি বিক্ষুব্ধদের উদ্দেশে বলেন, জুলাই যোদ্ধাদের সম্মান, নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতে কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সনদের অঙ্গীকারনামায় সংশোধন আনা হবে। তবে তার এই আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারেননি উপস্থিত আন্দোলনকারীরা।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, একপর্যায়ে বাইরে থাকা আন্দোলনকারীরা সংসদ ভবনের ১২ নম্বর গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। পরে ভেতরে থাকা জুলাই যোদ্ধারা বাইরে চলে আসে। এরপর তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোতল, চেয়ার নিক্ষেপ করে। এরপরেই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। টানা কয়েক দফা সংঘর্ষে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। আন্দোলনকারীরা সড়কে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আহত আতিকুল গাজী। তিনি জানান, তার বাসা উত্তরা এলাকায়। স্বাক্ষর হতে যাওয়া জুলাই সনদের অনুষ্ঠানে তারা মানিক মিয়া এভিনিউতে এসেছিলেন। সেখান থেকে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ করে। লাঠির আঘাতে আহত হন তারা। জুলাই আন্দোলনে আমি ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হই। পরবর্তীতে পঙ্গু হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে আমার হাতটি কেটে ফেলে। তার পরবর্তীতে ব্র্যাক আমাকে একটি কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেয়। এ হাত এখন আমি ব্যবহার করি। এ প্রতিবাদ জানাতে সংসদ ভবন এলাকাতে এসে, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী আমাদের জুলাই যোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। জুলাইয়ে যেই জায়গাতে গুলি খেয়েছি, আজকে আবার সেই জায়গায় আঘাত করে তারা আমার কৃত্রিম হাতটা ভেঙে দিয়েছে।
এ বিষয়ে আমরা ‘জুলাইযোদ্ধা’ সংসদের প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্য সচিব মাজহারুল ইসলাম আপন বলেন, জুলাইয়ে আমরা জীবন বাজি রেখে মাঠে ছিলাম। আমরা শুধু সরকারের কাছে স্বীকৃতি চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের কথার গুরুত্ব দেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই এমন কর্মসূচি দিয়েছি। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা জুলাই শহীদদের প্রতি চরম গাদ্দারি। উল্লেখ্য, জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল। তাদের দাবি, আন্দোলনের রক্তের ঋণ ও ত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে সনদে আইনি স্বীকৃতি, তদন্ত কমিশন গঠন এবং নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়নি।