Image description
 

দেশে এখন ‘সেইফ এক্সিট’ নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের এক বক্তব্য থেকে এই বিতর্কের সূত্রপাত। নাহিদ ইসলাম গত সপ্তায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেইফ এক্সিটের কথা ভাবতেছে।’ আরেক এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেছেন, মৃত্যু ছাড়া ‘কিছু উপদেষ্টা’র কোনো সেইফ এক্সিট নেই। আসলেই কি উপদেষ্টারা এক্সিট খুঁজছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না। দেশেই ছিলাম, এর আগেও বহু ঝড়ঝঞ্ঝা এসেছে। সেসব ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিহত করে দেশেই থেকেছি। বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটিয়ে যাব।’ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়।

সাধারণভাবে ‘সেইফ এক্সিট’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘নিরাপদ প্রস্থান’। নিরাপদ ও ঝামেলামুক্তভাবে কোনো স্থান, অবস্থা বা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার পথকে বোঝানো হয়। সাধারণত জরুরি অবস্থার সময়, ভবন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পথ ও উপায়গুলোকেও ‘সেইফ এক্সিট’ বলা হয়। কিন্তু রাজনীতিতে এই শব্দের একটা আলাদা মাহাত্ম্য বা অর্থ আছে। রাজনীতির প্রেক্ষাপটে, কোনো দল বা ব্যক্তির ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার বা কোনো সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হওয়ার একটি নিরাপদ ও সুবিধাজনক উপায়কে ‘সেইফ এক্সিট’ বলা হয়ে থাকে।

ক্ষমতাসীনরা জনআকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কাজ না করলে অথবা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করতে থাকলে এক পর্যায়ে জনরোষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশে এরকমের জনরোষ বা অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের আশংকা দেখা দিলে ক্ষমতাসীনদের জন্য ‘সেইফ এক্সিট’ অপরিহার্য হয়।

কেন ‘সেইফ এক্সিট’র কথা আসলো?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, শুধু অন্য উপদেষ্টারাই নন, নাহিদ ইসলাম নিজেও আসলে আতংকিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই ছাত্র কোটায় উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান নাহিদ ইসলাম। সরকারি ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছেন। তিনি সরকারে না থাকলে অন্য দু’জন ছাত্রনেতা এখনো সরকারে আছেন। এরাও অঘোষিতভাবে নাহিদ ইসলামের রাজনৈতিক দল এনসিপির সদস্য। নাহিদ ইসলাম সরকারে না থাকলেও নানাভাবে সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন। এ সরকার তাদেরই সরকার। সামনে জাতীয় নির্বাচন হলে ক্ষমতা হারাতে হবে। সেই আতংকেই ভুগছেন নাহিদ ইসলাম। আর তাই নিজেদের ব্যর্থতা, দায় ও অপকর্মের বোঝা অন্য উপদেষ্টাদের ওপর চাপিয়ে, চাপাবাজি করে বাঁচতে চাইছেন।

তিনি সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন প্রায় সাত মাস। এই সাত মাসে জনগণকে কি দিয়েছেন, তার কাছ থেকে রাষ্ট্রের অর্জন কতটা -এর জবাব দিতে পারবেন না মোটেই। বরং দেখা যাবে, এসব বিষয় ঘাঁটতে গেলে অনেক ভয়াবহ রকমের বিপরীত চিত্রই বেরিয়ে আসছে। সাধারণ মানুষ যে চরমভাবে আশাহত, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা যে আরও ব্যাপকহারে বেড়েছে- এসবের জন্য কারা দায়ী? উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও এনসিপি নেতা সারজিস আলমরা কী এর দায় এড়াতে পারবেন? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম বেনিফিসিয়ারি এরা। সরকারের শুরু থেকেই এরা ক্ষমতার মূল অংশীদার। সরকারে যারা আছেন অধিকাংশ উপদেষ্টার আমলনামা প্রায় একই।

ফ্যাসিবাদের পতনের পর মানুষ আশা করেছিল দীর্ঘদিনের দুঃশাসন, খুন, গুম, লুটপাট, অন্যায়-বৈষম্য, অরাজকতা, নির্বাচনহীনতা আর জুলুমের দুর্দিন কাটিয়ে দেশ যাবে সুশাসনের পথে। যাদের হাতে মানুষ নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখবে বলে আশা করেছিল, সেখানে তাদের চরমভাবে আশাহত হতে হয়েছে। জনগণ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন দেখছে না, বরং ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাধর অনেকের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবার পুরনো নীতিকেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখছে। এটাই তাদের আশাভঙ্গ করছে। এই জনহতাশা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপত্তি তৈরি করছে কিনা সেটা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আয়ু চৌদ্দ মাস অতিক্রম করলো। এই চৌদ্দ মাসের অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার ধারে-কাছেও নেই। দেশে জঞ্জাল-বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলার এতো অবনতি হয়েছে যে, পুলিশও এখন মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। এমনকি চুক্তি করেও ঘুষ লেনদেনের নজির স্থাপন করেছে এই অন্তর্বর্তী সরকার। নিজেদের আখের গোছানো, অন্তর্বর্তী সরকারের আয়ু দীর্ঘায়িত এবং বিএনপিকে মাইনাস করতে গিয়ে উপদেষ্টারা সবকিছুই লেজেগোবরে করে ফেলেছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা ও আখের গুছানোর নীতি অনুসরণ
নাহিদ ইসলাম ওই সাক্ষাতকারে একই সঙ্গে আরেকটি কথা বলেছেন, ‘অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে করেছে। যখন সময় আসবে, তখন আমরা এদের নামও উন্মুক্ত করব।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দুর্নীতিবাজ উপদেষ্টাদের তালিকা চেয়েছেন নাহিদ ইসলামের কাছে। তিনি নাহিদ ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আপনিও উপদেষ্টা ছিলেন। কোন কোন উপদেষ্টা দুর্নীতি করছেন, আপনি ভালো জানেন। সেই উপদেষ্টাদের তালিকা দিন।” নাহিদ ইসলাম অবশ্য এর জবাব দেননি।

এর আগে গত ৮ আগস্ট রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে বক্তব্যদানকালে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আব্দুস সাত্তার দাবি করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে। আব্দুস সাত্তারের ওই বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ সাংবাদিকদের কাছে এ রকমের দাবিকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এবিএম আব্দুস সাত্তারকে বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ হাজির করা জন্যও বলেন।

যদিও নিয়ম অনুযায়ী স্বচ্ছতার স্বার্থে উপদেষ্টাদের দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ লিখিতভাবে চাওয়া উচিত ছিল এবিএম আব্দুস সাত্তারের কাছে, কিন্তু শেখ আব্দুর রশিদ তা করেননি। বরং এর পরদিন অফিসার্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসে শেখ রশিদ এবং আব্দুস সাত্তারকে একে অন্যের কানে কানে কথা বলতে দেখা গেলো। বস্তুত এর পর থেকেই ইস্যুটি চাপা পড়ে যায়। আব্দুস সাত্তারও এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ রশিদও প্রমাণ আদায়ের কথা থেকে সরে যান। নিয়ম অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশনের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার কথা। দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তখন বলেছেন, উপদেষ্টাদের কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এসব প্রমাণ উদঘাটনের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে আর দেখা যায়নি।

শীর্ষনিউজ ডটকম এবং সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত চৌদ্দ মাসে এরা যা করেছেন আরও চৌদ্দ মাস ব্যাপী লিখলেও এদের দুর্নীতি-অপকর্ম ও বিতর্কিত কমকাণ্ডের ফিরিস্তি শেষ হবে না। গোটা উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩/৪ জন পাওয়া যাবে যারা মোটামুটিভাবে নিজেদের সুনাম রক্ষা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া বাকি প্রায় সবাই নিজেদের আখের গুছানোর ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন শুরু থেকেই। দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নেননি মোটেই। যে কারণে দেশের আজ এই চরম দুরবস্থা! উপদেষ্টাদেরও সেইফ এক্সিটের কথা ভাবতে হচ্ছে।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সংস্কারের নামে যেসব বুলি আওড়ানো হয়েছে গত চৌদ্দ মাসে এগুলোর কোনোটি নিয়েই মানুষের কখনো মাথাব্যথা ছিল না। বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনা উপদেষ্টারা, ধান্দাবাজ এনজিও কর্মীরা আর অন্তর্বর্তী সরকারের সুবিধাভোগীরা সংস্কারের পুঁথিগত বুলি আওড়াচ্ছেন। মুখে সংস্কারের কথা বললেও বাস্তবে এরা সংস্কার বিরোধী ভূমিকা পালন করছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বত্র বহাল রেখেছেন, এমনকি ফ্যাসিবাদীদের নতুন করে প্রমোটও করছেন।

সাধারণ মানুষ দ্রুত এর উত্তরণ চাচ্ছে। শুধু সাধারণ আমজনতাই নয়, অফিস-আদালতের সরকারি কর্মকর্তারাও হাঁফিয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। নানা শ্রেণির লোকদের হুমকি-ধামকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। নাহিদ-সারজিসদের অনুসারী সমন্বয়ক নামধারী মাস্তান ও চাঁদাবাজদের দাপটে একেবারেই অসহায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। একদিকে উপদেষ্টাদের দুর্নীতি, অন্যদিকে এসব মাস্তানের দাপটে সাধারণ মানুষ সরকারি দপ্তরগুলোয় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বস্তুত, এসব কারণেই জনরোষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
শীর্ষনিউজ