Image description

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার গদি রক্ষায় গত বছর গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) গোপন সভা করেছিলেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা। ফ্যাসিবাদের দোসর সেসব শিক্ষককে বিচারের আওতায় না এনে তড়িঘড়ি করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী ১৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন দুটি করে নিয়োগ বোর্ড বসিয়ে এ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন ববি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। শুধু তাই নয়, আওয়ামী আমলে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমেই এ পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে বিশ্বস্ত সূত্র।

এদিকে গত ১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯১তম সিন্ডিকেট সভায় এসব শিক্ষককে বিচারের আওতায় আনার জন্য কমিটি গঠন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এখন তারাই উপাচার্যকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে অধ্যাপক পদ বাগিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ফ্যাসিবাদের দোসরখ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি সাদেকা হালিম ও ড. মীজানুর রহমান, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এম রোস্তম আলী, ওপেন ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি সৈয়দ হুমায়ুন আখতার, ঢাবির মাহবুবা নাসরিন, ঢাবির সাবেক প্রো-ভিসি মুহাম্মদ সামাদ, ওপেন ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রো-ভিসি নাসিমা বানু, ববির সাবেক ভিসি হারুনুর রশিদসহ আওয়ামী সরকারের আমলে ২০২২ সালে রাষ্ট্রপতির (চ্যান্সেলর) নিযুক্ত বোর্ড মেম্বারদের দিয়েই ১৩টি বিভাগের ২৪ জন শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বোর্ড আয়োজন করা হয়েছে।

অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে আবেদনকারীদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন ফ্যাসিবাদের দোসর, যারা জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করে গোপন সভায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। চব্বিশের ৪ আগস্টের সেই গোপন সভায় বক্তব্য দেওয়া ১৩ শিক্ষকের ১১ জন এই পদোন্নতির দৌড়ের তালিকায় সবার আগে।

এদিকে, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম যোগদানের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও ফ্যাসিস্ট বোর্ড মেম্বার পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ সেই বোর্ড সদস্যদের নবায়ন না করেই ফ্যাসিবাদের গঠিত বোর্ডেই তড়িঘড়ি করে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পদোন্নতি দিতে যাচ্ছেন। এর জন্য ইতোমধ্যে সাড়ে ছয় লাখ টাকা বোর্ডের খরচ বাবদ অর্থ বরাদ্দ করে অনুমোদন করেছেন তিনি। আগামী রোববার থেকেই বসতে যাচ্ছে পদোন্নতি বোর্ড।

অভিযোগ উঠেছে, অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ছয়টি অধ্যাপক পদকে প্রভাষক পদে পরিবর্তন করে মঞ্জুরী কমিশনের কাছে অনাপত্তির জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। অনাপত্তি পত্র ব্যতীত আগেই ভিসি বোর্ড আয়োজন করছে। এজন্য লবিং করে ঢাকা থেকে অনাপত্তি আনার জন্য গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকায় গিয়েছেন বলেও জানা যায়। কারণ ইউজিসির অনাপত্তি না পেলে অবৈধ হবে পদোন্নতি।

এদিকে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক সাদমান সাকিব বিন রহমান চাকরি থেকে চলতি বছরের ১ এপ্রিল অব্যাহতি চাইলেও ৮ মাস অতিবাহিত হয়েছে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে না। কারণ অব্যাহতির মাধ্যমে পদ শূন্য হলে তাদের পদোন্নতি হবে না।

 

এছাড়া বিভিন্ন বিভাগে ৫০-এর কাছাকাছি ‘প্রভাষক’ পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে আওয়ামী দোসরদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে ।

একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, পদোন্নতি পেতে যাওয়া শিক্ষকরা শূন্য থাকা ৫০টি পদে পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিতে ভিসিকে চাপ প্রয়োগ করেছেন। এছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না দিলে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও অনশন করবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন।

 

এদিকে, গোপন সভায় অংশ নেওয়া মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জামাল উদ্দিন ইতোমধ্যে অনশন করবেন বলে ঘোষণাও দিয়েছেন তার ফেসবুকের একটি পোস্টে ।

তিনি ওই পোস্টে লিখেন, প্রিয় সহকর্মীরা যত কথাই বলি না কেন আপনাদের কোনো রেসপন্স নেই। আমি অনেক ভেঙে পড়েছি। আজ থেকে আমি কিছু একটা (অনশন) করতে যাচ্ছি। পরে তার অনশনে বসা বিষয়ে একটি ব্যানারও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

বোর্ড বন্ধ করতে উপাচার্যকে ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীদের আবেদন

এদিকে, ফ্যাসিবাদী শিক্ষকদের বিচারের পরিবর্তে পদোন্নতির তৎপরতার ঘটনায় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার বিকেলে ববি উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত আবেদন জমা দিয়ে তারা জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গঠিত পদোন্নতি বোর্ডকে তারা ‘ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

 

ছাত্র সংগঠনের প্রতিক্রিয়া

ববি শাখা শিবির নেতা মোকাব্বেল শেখ আমার দেশকে বলেন, উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই গণহত্যার সহযোগীদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে না। তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিন্তু এখন তার কার্যক্রম উল্টো, ফ্যাসিবাদীদেরই সুবিধা দিচ্ছেন।

 

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের মতের বিরোধিতা করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে প্রহসনের পদোন্নতি বোর্ড গঠন করছেন। অথচ একই কারণে পূর্ববর্তী উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিনকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। আমরা নতুন শিক্ষক নিয়োগ ও সেশনজট নিরসন চেয়েছিলাম, কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের প্রতিটি পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের প্রতি দ্বিচারিতার পরিচায়ক। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং অবিলম্বে এই প্রহসন বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।

 

ববি শাখা ছাত্রদল নেতা মোশাররফ হোসেন বলেন—বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে দীর্ঘদিন ধরে দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশাসন ছাত্রদের চাহিদার পরিবর্তে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। জুলাই আন্দোলনে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিচার না করে কেবল নামমাত্র কমিটি করেছে, যা দুঃখ ও হতাশাজনক। ফ্যাসিবাদী শিক্ষকদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলছি—এখানে কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন চলবে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলব।

 

ফ্যাসিবাদী শিক্ষকদের বিচার না করে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টিতে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, এটি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।

বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম মুঠোফোনে আমার দেশকে বলেন, আমি বিশেষ কাজে ইউজিসিতে আছি। বিচারের দাবিতে কমিটি করা হয়েছে, সবকিছু চলমান আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন।

 

এ বিষয়ে প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. রাহাত হোসাইন ফয়সাল আমার দেশকে বলেন, অপরাধ ও পদোন্নতি দুটো ভিন্ন বিষয়। একাডেমি কাজ একাডেমিক গতিতে চলবে আর বিচারিক বিষয় শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী চলবে। কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যেহেতু সিন্ডিকেট সদস্য না তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না তবে এ জাতীয় কিছু হলেও হতে পারে। সেটা উপাচার্য ভালো বলতে পারবেন।