
এক যুগেরও বেশি সময়, প্রায় দুই যুগ ধরে এইচএসসি পরীক্ষার যেমন ফল আসছিল, এবার ফল তেমন নয়। ২০০৯ সালের পর থেকে পাসের হার যেখানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে, এবার সেখানে পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে; ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এই পাসের হার গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর সঙ্গে বেড়েছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, কমেছে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সব মিলিয়ে বোর্ডের কঠোর মূল্যায়ন ও সহানুভূতির নম্বর বন্ধের ফলে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলে এই ধস নেমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একইসঙ্গে ‘শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে’ বলেও মনে করা হচ্ছে।
এ বছরের আগে এইচএসসির ফলাফলে প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম ছিল ২০০৪ ও ২০০৫ সালে। ২০০৪ সালে পাসের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরের বছর ২০০৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশে। এরপর আর কখনও এইচএসসির ফল এতটা নিচে নামেনি। সেই হিসেবে দুই দশকের বেশি সময় পর এবারের ফলাফলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেখা গেছে।
শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, ২০০৬ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৬৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৬৪ শতাংশের ওপরে, ২০০৮ সালে তা প্রায় ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়। ২০০৯ সালে পাসের হার নেমে যায় ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশে। পরবর্তী বছরগুলোতে পাসের হার সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু তিন বছর— ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পাসের হার ৭০ শতাংশের নিচে নেমেছিল।
এর আগে এত কম পাসের হার দেখা গিয়েছিল ২০০৪ সালে, তখন পাসের হার হয়েছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ
আর কোভিড-১৯ মহামারির বছরে (২০২০) সরাসরি পরীক্ষা না হওয়ায় সবাই ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ উত্তীর্ণ হয়। পরের দুই বছর (২০২১ ও ২০২২) পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৮৪ ও ৯৫ শতাংশের বেশি। তবে ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ৮০ শতাংশের নিচে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেন ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯ হাজার ৩০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একজনও পাস করতে পারেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০২টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৫টি। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ১৩৭টি। একইভাবে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। গতবার শতভাগ পাস করেছিল ১ হাজার ৩৮৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে, এবার সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫-এ।
৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এবার পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ জন। এর মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৬ জন। পাসের হার ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৬৩ হাজার ২১৯ জন। পাসের হার সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, কম কুমিল্লাতে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন ইংরেজিতে, এরপর হিসাববিজ্ঞানে।
ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর কুমিল্লায় ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এ ছাড়া রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৫৯.৪০ শতাংশ, যশোর বোর্ডে পাসের হার ৫০.২০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৫২.৫৭ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৬২.৫৭ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৫১.৮৬ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৫৭.৪৯ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে পাসের হার ৫১.৫৪ শতাংশ।
মাদরাসা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেন ৮২ হাজার ৮০৯ জন। পাস করেছেন ৬২ হাজার ৬০৯ জন। পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এবার পরীক্ষা অংশ নেন ১ লাখ ৫ হাজার ৬১০ জন। এরমধ্যে পাস করেছেন ৬৬ হাজার ১৮৫ জন; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৬১০ জন।
এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছেন ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। কম পেয়েছে সিলেট বোর্ডে। এ ছাড়া রাজশাহী বোর্ডে ১০ হাজার ১৩৭ জন, দিনাজপুর বোর্ডে ৬ হাজার ২৬০ জন, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৬ হাজার ৯৭ জন, যশোর বোর্ডে ৫ হাজার ৯৯৫ জন, মাদরাসা বোর্ডে ৪ হাজার ২৬৮ জনম, কুমিল্লা ২ হাজার ৭০৭ জন, ময়মনসিংহ বোর্ডে ২ হাজার ৬৮৪ জন, বরিশাল বোর্ডে ১ হাজার ৬৭৪ জন, কারিগরি বোর্ডে ১ হাজার ৬১০ জন জিপিএ ৫ পেয়েছেন।
বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে ইংরেজি, হিসাব বিজ্ঞান ও আইসিটিতে। এরমধ্যে এবার বেশি ফেল করেছেন হিসাব বিজ্ঞানে। এবার এই বিষয়ে ফেল করেছেন ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর ইংরেজিতে ফেল করেছেন ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বিষয়ে ঢাকা ও বরিশালে পাসের হার ৭০ শতাংশ হলেও বাকি বোর্ডগুলোতে তা ৬০ শতাংশের নিচে। সবচেয়ে খারাপ করেছে যশোর বোর্ডে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাস করেছে মাত্র ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর আইসিটিতে ২৭ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন।
বোর্ডগুলো আরও জানাচ্ছে, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে নম্বর পাওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে ফেলও এবার বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় সহানুভূতির নম্বর বা অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার প্রচলন ছিল। এতে অনেক শিক্ষার্থী সীমিত প্রস্তুতি নিয়েও পাস করতেন। কিন্তু এবার সেই নম্বর পুরোপুরি বন্ধ করে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত সক্ষমতার প্রতিফলন এসেছে ফলাফলে।
সেই সঙ্গে মফস্বলের কলেজগুলোতে অনলাইন বা ডিজিটাল কনটেন্টভিত্তিক পড়াশোনার অভাব, শিক্ষকের ঘাটতি এবং পরীক্ষার্থীদের দুর্বল লেখনশৈলী ফলাফলের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে প্রতি বছরের মতো এবারও ক্যাডেট কলেজগুলোতে সাফল্যের ধারা বজায় রয়েছে। দেশের ১২টি ক্যাডেট কলেজের ৫৮৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫৮৭ জন জিপিএ–৫ পেয়েছেন। শতভাগ পাসের হার ও ৯৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ জিপিএ ৫ নিয়ে তারা ধরে রেখেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য।
শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে
সার্বিক ফলের বিষয়ে বাংলাদেশ আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেছেন, খাতা মূল্যায়নে আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দেইনি বা নির্দিষ্ট করে দেইনি যে এইভাবে নম্বর ছাড় দেবেন অথবা ওভারমার্কিং করবেন। আর বেশি বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে— এ রকম নির্দেশনার তো প্রশ্নই ওঠে না। এইচএসসির ফলাফল খারাপ নয়, বরং এটি বাস্তবতার প্রতিফলন। আমরা ফল বানাইনি। বাস্তব চিত্রটাই এবার সামনে এসেছে। আর শিক্ষার্থীরা এখন টেবিল পড়ার টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদেরও ভাবতে হবে।
ইংরেজি ও আইসিটিতে ফেলের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী ইংরেজিতে পাসের হার নেমে এসেছে ৭৭ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইংরেজিতে এমসিকিউ বাদ থাকায় পরীক্ষা তুলনামূলক কঠিন হয়েছে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারের এইচএসসি ফলাফল কঠোর মূল্যায়নের বাস্তব প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা সহানুভূতির নম্বর বা নমনীয় মূল্যায়নের সুবিধা পাচ্ছিল। এবার সেই প্রথা বন্ধ করে পুরোপুরি মাননির্ভর মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাই পাসের হার কিছুটা কমলেও এটি শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের ইতিবাচক সূচনা বলে আমরা মনে করি। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা আরও প্রস্তুত হয়ে অংশ নেবেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।