
জাহিদ মালেক একা দুর্নীতি করেননি। পুত্র, কন্যা, সহধর্মিণী এবং নিকটাত্মীয় মিলে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে রীতিমতো দুর্নীতির উৎসব করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং মানিকগঞ্জে মালেক মানেই দুর্নীতি-এ কথাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের এক মেয়াদে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, আরেক মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন জাহিদ মালেক।
যাতে ছিলেন জাহিদ মালেকের স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে, বোন, ফুপাতো দুই ভাই এবং মামাতো ভাই ও তাঁর ছেলে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের স্ত্রী শাবানা চাঁদাবাজ পালতেন।
প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকারকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেন শাবানা মালেক। প্রতিদিন পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজির ১ লাখ টাকা তাঁকে দিতে হতো। একপর্যায়ে চাঁদাবাজি নিয়ে বাবুল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেন। এ ছাড়া ক্ষমতাবলে একাধিক স্কুলের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন শাবানা। জাহিদ মালেকের পারিবারিক ব্যবসা ছিল সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
আদালত সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ড. রুবিনা হামিদ, সিইও মোহম্মদ নূরুল ইসলাম, ডিএমডি সুমনা পারভীনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এটির চেয়ারম্যান জাহিদ মালেকের বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। পরিচালক হিসেবে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেক, ছেলে রাহাত মালেক ও বোন রুবিনা হামিদের স্বামী কাজী আখতার হামিদ। রুবিনা হামিদের আগে জাহিদ মালেক কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। অর্থাৎ আইন অনুসারে কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় যে ব্যয় করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে।
অতিরিক্ত ব্যয় করা এসব টাকার ৯০ শতাংশই বিমা গ্রাহকের জমাকৃত। এ কারণে গ্রাহকের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকতেই এ বিমা কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেয় জাহিদ মালেক পরিবার। এ শেয়ার বিক্রির টাকা পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পারিবারিক সিন্ডিকেটের বাইরে জাহিদ মালেকের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল দলীয় আরেকটি সিন্ডিকেট। এ চক্রে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১০ নেতা-কর্মী।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে জাহিদ মালেক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যেমন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তেমন তাঁর দলীয় সিন্ডিকেটের সদস্যদেরও শত শত কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন। পারিবারিক ও দলীয় এ দুই সিন্ডিকেটের সদস্যদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তাঁরা নিয়োগ ও টেন্ডারবাণিজ্য, জমি ও বাড়ি দখল, বালুমহাল ইজারা, পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অন্তত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।
জাহিদ মালেক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ খ ম সুলতানুল আজম। বাসা মানিকগঞ্জ সদরের পূর্ব দাশড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি বদলে যেতে থাকে সুলতানুলের আর্থিক অবস্থা।
জাহিদ মালেকের প্রশ্রয় ও আশীর্বাদে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। অনুসন্ধানে সুলতানুল আজমের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। মানিকগঞ্জ জেলার পুরো পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। সড়কে নতুন গাড়ি নামাতে হলে চাঁদা দিতে হতো সুলতানুলকে।
তিনি দীর্ঘদিন জেলা ট্রাক মালিক সমিতি এবং এসি লিঙ্ক বাস মালিক সমিতির সভাপতি। নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন কিংবা জমি কেনাবেচাও তাঁকে চাঁদা না দিয়ে করা যেত না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরসহ জেলার সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডারে ছিল তাঁর একক নিয়ন্ত্রণ। জাহিদ মালেকের তদবির ও ছত্রছায়ায় তিনি নিম্নমানের কাজ করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁর কবল থেকে বাদ যায়নি মানিকগঞ্জ ডায়াবেটিস সমিতির অফিসও। সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে বসে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
টাকার বিনিময়ে জনবল নিয়োগ এবং কেনাকাটার নামে আত্মসাৎ করেছেন বিপুল অর্থ। মানিকগঞ্জ ও আশপাশের বিভিন্ন জেলার মাদক কারবারের সিন্ডিকেটের সঙ্গেও তাঁর সংযোগ ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাঁকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গডফাদার হিসেবে চেনেয় এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা নরেন্দ্র ম লের ১২ বিঘা জমি জোর করে দখল করেছেন। এ ছাড়া সদর উপজেলার আরও অনেকের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সুলতানুল আজমের মালয়েশিয়ায় বাড়ি রয়েছে বলে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। জেলা সদরের শিববাড়ীতে পাঁচ তলা বাড়ি রয়েছে তাঁর। শহরের শহীদ রফিক সড়কে স্বর্গ ভবন নামে ৬ শতাংশ জায়গায় ১০ তলা একটি ভবন রয়েছে। সুলতানুলের আরও একটি সাত তলা ভবন রয়েছে মানিকগঞ্জ শহরের পৌর ভবনসংলগ্ন এলাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে চলাচল করা তাঁর ৫০টির বেশি ট্রাক ও এসি লিঙ্ক বাস রয়েছে। মানিকগঞ্জ ও সাটুরিয়া উপজেলায় নামে-বেনামে রয়েছে কৃষিজমি। রয়েছে দুটি প্রাডো গাড়ি। শহীদ রফিক সড়কে আছে ২৪ শতক জমি, যেখানে প্রতি শতক জমির দাম ৩০ লাখ টাকা।
জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেনের ক্ষমতার দাপটে জিম্মি ছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। ইসরাফিল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। জনপ্রিয়তা না থাকার পরও ভোট কেন্দ্র দখল করে জাহিদ মালেক ইসরাফিলকে চেয়ারম্যান বানান বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসরাফিলের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
মানিকগঞ্জের সরকারি বালুমহাল যেন সোনার খনি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে ইসরাফিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। সদর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলত তাঁর লোকজন। একদিকে মন্ত্রীর আত্মীয়, অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান পরিচয়ে বেপরোয়া ছিলেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি কাজের ঠিকাদারি করতেন। তাঁর দাপটে অন্য কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারতেন না। ইসরাফিলের নামে-বেনামে সম্পদ রয়েছে মানিকগঞ্জ এবং রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। মানিকগঞ্জে তাঁর দুটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া সাভারে একটি ছয় তলা ভবন আছে।
সুলতানুল আজমের মাধ্যমে জাহিদ মালেকের এ সিন্ডিকেটে ঢোকেন যুবলীগ নেতা, জেলা পরিষদের সদস্য আবুল বশর। টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক কারবারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। তাঁর মালয়েশিয়ায় বাড়ি রয়েছে। তিনি মালয়েশিয়ায় টাকা পাচারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার শহীদ রফিক সড়কে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। স্থানীয় নয়াডিঙ্গি এলাকায় তাঁর নামে কয়েক একর জমি আছে। রয়েছে ছয়টি এক্সকেভেটর ও পাঁচটি ড্রেজার মেশিন।
৪০-৫০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ১০ কুতুবের আরেকজন আবদুর রাজ্জাক রাজ। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং পৌর কমিশনার। টাকা পাচারের সুবিধার জন্য তিনি ভারতে একটি বাড়ি বানিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেখানে শ্যালিকা ও তাঁর স্বামী বসবাস করেন। পূর্ব দাশড়ায় ৫০ ও তেরগ্রামে ৩৫ শতাংশ জমি আছে তাঁর। শহরের তমা ক্লিনিকে শেয়ার রয়েছে রাজ্জাকের। যুবলীগের আরেক নেতা আবু বকর খানের সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। জাহিদ মালেকের প্রশ্রয়ে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি করে যুক্তরাষ্ট্রে টাকা জমিয়েছেন তিনি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা থাকেন দেশটিতে। সেখানে তিনি একটি বাড়ি কিনেছেন। জাহিদ মালেক ও তাঁর ছেলের ব্যবসায়িক টাকা পাচারেও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাজ্জাকের।
হরিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিম মোল্লার সম্পদের পরিমাণ ২০-৩০ কোটি টাকা। ঢাকায় পাঁচ তলা ও মানিকগঞ্জে তিন তলা দুটি বাড়ি রয়েছে তাঁর। ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে একাধিক। তিনি নামে-বেনামে সম্পদ গড়েছেন। আর এসব সম্পদ গড়েছেন মুক্তিপণ আদায় ও তদবির বাণিজ্য করে। জাহিদ মালেকের এলাকার আত্মীয় পরিচয়ে তিনি সচিবালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। চাকরি দেওয়ার কথা বলে শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সাটুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হুসেন খান জাহিদ মালেকের দাপট দেখিয়ে অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পদ গড়েছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখন শোচনীয় অবস্থা ছিল আবদুর রাজ্জাকের পরিবারের। ধারদেনা করে চলত সংসারের খরচ। ২০০৮ সালের পর তিনিও জাহিদ মালেকের সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন। মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের এই আহ্বায়ক মিথ্যা অভিযোগে করা মামলায় ফাঁসিয়ে নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢুকিয়ে টাকা আদায় করতেন। তাঁর এখন ছয় তলা ভবন রয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া চলেন না।
মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বাস, ট্রাক ও সিএনজি স্টেশনে চাঁদাবাজি করতেন। মহাসড়কের চাঁদাবাজি দেখভালের দায়িত্ব ছিল তাঁর। সাবেক মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় রাজধানীর উত্তরায় ফ্ল্যাট ও ঢাকার সাভারে বাড়ি বানিয়েছেন। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁর নামে জমি আছে। তাঁর রয়েছে পরিবহন ব্যবসাও।
সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খাবার সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মামাতো ভাই ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খানের (জ্যোতি) ছেলে মহিদ খান। নিম্নমানের খাবার দিয়ে তিনি বিপুল টাকা কামিয়েছেন। বাবা-ছেলে মিলে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করতেন। তাঁদের লামিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আছে। কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজে আউটসোর্সিং চাকরি দিতে মহিদ খান জনপ্রতি ৩-৫ লাখ টাকা নিতেন। হরগজের গরুর হাট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন তিনি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে জনপ্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ করে টাকা নিতেন। এভাবেই সবাই মিলে পারিবারিক দুর্নীতির একটি চক্র গড়ে তোলেন জাহিদ মালেক।