Image description

নানা আলোচনা সমালোচনা থাকার পরও আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ যেন উৎসবের মতো। অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের আনন্দময় মুহূর্ত হয়ে ওঠে— হাসি, উৎসব আর স্বপ্নের রঙে ভরে ওঠে পরিবার। কম সংখ্যকের চিত্র থাকে ভিন্ন। কিন্তু এবার দৃশ্য উল্টো;  সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি ফলাফল যেন এক সতর্ক বার্তা। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার মাত্র ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কমে যাওয়া এই হার কেবল সংখ্যার পতন নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন।

এক সময় গড় পাসের হার ৬০ শতাংশের ওপরে থাকাকে স্বাভাবিক ধরা হতো। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। পরবর্তী দশকজুড়ে তা ক্রমে বেড়ে ৭০–৭৫ শতাংশে গিয়ে স্থিতি পায়। এরপর আসে কোভিড-১৯ মহামারি—যা পাল্টে দেয় পুরো চিত্র। ২০২০ সালে সরাসরি পরীক্ষা হয়নি; ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাই উত্তীর্ণ ঘোষণা পায়। ২০২১ ও ২০২২ সালে পরীক্ষা নেওয়া হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, নম্বর প্রদানে ছিল উদারতা। ফলে পাসের হার বেড়ে দাঁড়ায় এক বছর ৮৪ শতাংশের বেশি, আরেক বছর ৯৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালে বাস্তব পরীক্ষার নিয়মে ফিরে আসতেই ফল কমে ৮০ শতাংশের নিচে নামে। আর ২০২৫ সালে এসে নামল ৫৭ শতাংশে—যা নিঃসন্দেহে একটি অ্যালার্ম বেল। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এবার ফলাফল কৃত্রিম উজ্জ্বলতার মুখোশ খুলে দিয়েছে। এতদিন আমরা শিক্ষার মানের পরিবর্তে সংখ্যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি—পাসের হার, GPA–৫-এর সংখ্যা বা বোর্ডের গড় ফলাফলের হিসাব দিয়েই সাফল্য মাপা হয়েছে। কিন্তু এইবারের কঠোর মূল্যায়ন সেই বাহ্যিক সাফল্যের ভেতরকার শূন্যতা প্রকাশ করেছে।

বোর্ডভেদে ফলাফলের পার্থক্যও স্পষ্ট। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, কিন্তু কুমিল্লা বোর্ডে মাত্র ৪৮.৮৬ শতাংশ। এর অর্থ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার মান, অবকাঠামো ও শিক্ষক প্রস্তুতির মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। কোথাও ল্যাব, লাইব্রেরি, ও প্রযুক্তিগত সহায়তা তুলনামূলক উন্নত; কোথাও শিক্ষকের ঘাটতি ও দুর্বল মনিটরিং প্রভাব ফেলছে ফলাফলে। আরও উদ্বেগের বিষয়, GPA–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০২৪ সালে যেখানে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন শিক্ষার্থী GPA–৫ পেয়েছিল, এবারে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জনে। এই হ্রাস দেখায়, আগের বছরের তুলনায় এবার মূল্যায়ন অনেক কঠোর ছিল, এবং “সহজ” প্রশ্ন বা নমনীয় নম্বর প্রদানের জায়গা কমেছে।

অন্যদিকে, সমাজ ও প্রশাসনিক সংস্কৃতিও শিক্ষাকে সংখ্যার খেলায় পরিণত করেছে। বহু প্রতিষ্ঠান পাসের হার বা GPA–৫ পাওয়ার সংখ্যা দিয়েই নিজেদের ‘সফল’ বলে দাবি করেছে। এ প্রবণতা শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করেছে। যখন শিক্ষার লক্ষ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিশ্লেষণ, চিন্তাশক্তি, ও বাস্তবজীবন-ভিত্তিক জ্ঞান পেছনে পড়ে যায়। তবে এই পরিস্থিতি একেবারে হতাশার নয়। বরং এটি হতে পারে পুনর্জাগরণের সুযোগ। এখন সময় এসেছে শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামোতে পরিবর্তন আনার। শুধু পরীক্ষার ধরন নয়, পাঠদানের ধরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আনতে হবে গুণগত সংস্কার। শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে, তাদের যুক্তিবোধ ও প্রয়োগক্ষমতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার আধুনিকীকরণে প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা ব্যবস্থা; যাতে শিক্ষার্থীরা ভয় নয়, আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনে স্বচ্ছতা, প্রশ্ন প্রণয়ন ও মূল্যায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কোনো সংখ্যার খেলা নয়। ৫৭ শতাংশ পাসের হার হয়তো হতাশাজনক শোনায়, কিন্তু এটি বাস্তবতার আয়না যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে শিক্ষার মান কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এখনই সময় সেই সংকেত বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার। যদি এখন না জাগি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু পরীক্ষায় ফেল করবে না; জীবনের প্রতিযোগিতাতেও পিছিয়ে পড়বে। তাই এই ফলাফলকে ‘বিপর্যয়’ নয়, বরং এক সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখা উচিত যা আমাদের শিক্ষা কাঠামোকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। শিক্ষা মানে পাস নয়, শিক্ষা মানে প্রস্তুতি জীবনের জন্য, সমাজের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।

লেখক: ন্যাশনাল এসোসিয়েট এন্ড কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ (বাংলাদেশ), আইএসএইচআর