
দেশের ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের দ্বৈতচিত্র দেখা যাচ্ছে— আমানত বাড়ছে, কিন্তু ঋণ কমছে। ১৭ মাস পর ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি আবারও দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। অর্থাৎ মানুষের হাতে থাকা টাকা এখন ব্যাংকে জমা হচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয় সংকোচনের কারণে মানুষের হাতে বাড়তি টাকাও থাকছে না। উপরন্তু, অনেককে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাতে হচ্ছে। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। ফলে অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য—টাকা ব্যাংকে জমা হচ্ছে, কিন্তু বাজারে ঘুরছে না।
১৭ মাস পর দুই অঙ্কে আমানতের প্রবৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের আগস্ট মাস শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০২ শতাংশে, যা এক মাস আগেও ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর আগে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই হার দুই অঙ্কে ছিল (১০.৪৩ শতাংশ)। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানত বাড়ার প্রধান কারণ হলো— ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কমে যাওয়া। তিন মাস আগেও এসব সিকিউরিটিজে সুদ ছিল ১১-১২ শতাংশ, যা এখন ৯-১০ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে ব্যক্তি ও করপোরেট বিনিয়োগকারীরা সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে টাকা সরিয়ে ব্যাংক আমানতে রাখছেন।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “ট্রেজারি বিল-বন্ডে আকর্ষণ কমে গেছে। ফলে অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আবার আমানত রাখছে। তারল্য এখন কিছুটা স্বস্তিতে আছে।”
একই মত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানেরও। তিনি বলেন, “ট্রেজারি বন্ডের ফলন কমে যাওয়ায় আমানতে টান পড়েছিল, এখন তা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকের নগদ অবস্থান শক্ত হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদ ৯.৫০ শতাংশ, ১৮২ দিনের ৯.৭১ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের ৯.৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি (৫-২০ বছর) ট্রেজারি বন্ডের হার ৯.৩৩ থেকে ৯.৮৯ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার কিনেছে। এতে টাকার প্রবাহ বেড়েছে, ব্যাংকগুলোর হাতে বাড়তি তারল্য এসেছে, যা আমানত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।”
এছাড়া ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থ— অর্থাৎ ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ গত এক বছরে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ কমেছে। ২০২৫ সালের আগস্ট শেষে এ খাতে নগদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি। এর মানে, আগের তুলনায় মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখার প্রতি বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
অপরদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে ২০২৫ সালের আগস্টে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে এই হার ছিল ১০.১৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় অর্ধেক হারে নেমে এসেছে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি।
বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে আছে তিনটি প্রধান কারণ—উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় ঋণ সুদহার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ, যা উদ্যোক্তাদের কাছে অস্বস্তিকর। এর ফলে নতুন শিল্প বা ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে অনেকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদহার ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বাধা তৈরি করছে। ব্যবসায়ীরা এখন নতুন প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। স্থিতিশীলতা ফিরলে ঋণপ্রবাহ বাড়বে।” অপরদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির চাপ, পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন এবং খেলাপি ঋণও ঋণ বিতরণে প্রভাব ফেলছে।
ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আমানত বাড়লেও তা থেকে ঋণ দিতে পারছে না অনেক ব্যাংক। কারণ— উচ্চ খেলাপি ঋণ, সুদবাজারের অস্থিরতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি মনেটারি পলিসি। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি রিজার্ভ পুনর্গঠন ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগতভাবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ফলে নতুন ঋণ বিতরণে সীমাবদ্ধতা এসেছে, যা বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে ধীর করছে।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হুসেইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা এখন টার্গেটেড ঋণ দিচ্ছি— যেসব খাত উৎপাদনমুখী ও রফতানিতে সহায়ক, কেবল সেগুলোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।”
আমানত-ঋণ অনুপাতের পরিবর্তন
বর্তমানে ব্যাংক খাতে গড় আমানত ও ঋণ অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল প্রায় ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলোর হাতে এখন তুলনামূলক বেশি নগদ অর্থ রয়েছে, যা তারা ঋণে দিতে পারছে না। এই অতিরিক্ত তারল্য আবার দীর্ঘমেয়াদে মুনাফা কমিয়ে দিতে পারে, যদি বিনিয়োগে প্রবাহ না বাড়ে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক দ্বৈত বাস্তবতার মোড়ে—একদিকে ব্যাংকে আমানত বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ স্থবির।
এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে হলে সুদহার স্থিতিশীল করা, আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং নীতি সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থের প্রবাহকে উৎপাদনমুখী করতে হবে। তাদের ভাষায়, “ব্যাংকে টাকা ঘুমোচ্ছে, কিন্তু বাজারে কাজ করছে না।” বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নীতিগত স্থিরতা বজায় রেখে বিনিয়োগমুখী ঋণ প্রবাহ জোরদার করতে পারে, তাহলে অর্থনীতির এই দ্বৈতচিত্র শিগগিরই বদলে যেতে পারে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতি কমছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি
দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে সরকারি সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমেছে। একই সময়ে বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ঋণের ওপর চাপ অর্থনীতিকে নতুনভাবে সতর্ক করছে।
সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাস আগস্টে ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। বছরের তুলনায় অবশ্য কিছুটা কম। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বাসাভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার ও আমদানি ব্যয়ের চাপ মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৮৮ শতাংশ
সঞ্চয়পত্রের বিক্রি চলতি বছরের আগস্টে কমে দাঁড়িয়েছে ২৮৯ কোটি টাকায়, যা গত বছরের আগস্টের তুলনায় ৮৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। ২০২৪ সালের আগস্টে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত হয়েছে—অর্থনৈতিক মন্দা ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস—বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় সঞ্চয়ের জন্য অতিরিক্ত টাকা হাতে নেই। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তিতে পরিশোধ বৃদ্ধি– নতুন বিনিয়োগের জায়গা সংকুচিত হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেলে সরকারকে ব্যাংক খাতের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, ফলে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক নিরাপত্তার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর মুনাফার ওপর সংসার চালান। বিক্রি কমে যাওয়ায় তাদের আর্থিক নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে ১ হাজার ৫৭২ কোটি টাকায়। সঞ্চয়পত্রের স্থিতিও কমেছে ১১ হাজার কোটি টাকা, এখন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায়।
বিনিয়োগ প্রস্তাব বাড়ছে, কিন্তু বাস্তবায়নে গতি কম
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা—বিডা, বেপজা, বেজা, বিসিক ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা পড়েছে প্রায় ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ, যার মধ্যে ৬৫ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ।
বিডার ব্যবসায় উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি বলেন, “প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। বিদেশি কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিট সহজ করা, ‘বাংলাবিজ’ নামে একক প্ল্যাটফর্ম চালু ও সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হচ্ছে।”
সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আগ্রহ দেখা গেছে অ্যাডভান্সড টেক্সটাইল, ওষুধ, আইটি, মেডিকেল ডিভাইস ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত খাতে। তবে বাস্তবায়নের গতি এখনও ধীর। কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বলছেন—ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন, ডলারের দাম অনিশ্চিত, আর বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল নয়।
বিদেশি বিনিয়োগে আশার আলো
বৈশ্বিক মন্দা ও আঞ্চলিক সংঘাতের মধ্যেও ২০২৫ সালের জানুয়ারি–জুন সময়ে নিট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এফডিআইয়ের বড় অংশই এসেছে পুনঃবিনিয়োগ হিসেবে—অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফা দেশে রেখেই নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে।