
রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগার তৃতীয় দিনেও পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতেও রাসায়নিক গোডাউন থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। জানা যায়নি ভেতরের অবস্থা। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠন করা হয়েছে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি। এদিকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে থাকা ১৬ জনের মরদেহের মধ্যে একজনের লাশও স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
গতকাল সরজমিন দেখা যায়, শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর ভবনের আনোয়ার ফ্যাশনের আগুন নিভে গেলেও আলম ট্রেডার্স নামে কেমিক্যালের গোডাউন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বর্তমানে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট কাজ করছে। লুব দিয়ে পানি ছিটানোর পর এখন পানি দিয়ে ভবনের ভেতরের পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক ড্রেন আউট করা হচ্ছে। পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে গেলেই রাসায়নিকের তেজস্ক্রিয়তায় নাক জ্বলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে এই বিষক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে ভবনের অদূরে রূপনগর সড়কের পাশে লাল ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বারবার ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা, পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা উৎসুক জনতাকে সরে যেতে অনুরোধ করছেন।
আগুন লাগা ভবনের ভেতরের অবস্থা জানতে গতকাল সকালে ফায়ার সার্ভিসের দু’জন ফায়ার ফাইটার কেমিক্যাল স্যুট (বিশেষ সুরক্ষা পোশাক) পরে আলম ট্রেডার্সের রাসায়নিক গোডাউনে প্রবেশ করেন। তাদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ভেতরে থরে থরে সাজানো রয়েছে রাসায়নিকের প্যাকেট। সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই। ভবনের ভেতরে ওঠা-নামার সিঁড়ি থেকে শুরু করে সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেতরে এখনো আগুনের অসহনীয় তাপ। ছাই আর ধোঁয়ায় কিছুই চোখে দেখা যাচ্ছে না। আর আগুনে পোড়া ভবন ও উদ্ধারকাজ কীভাবে চলছে তা দেখতে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন (বিসিআইসি) সিনিয়র জিএম মনজুর রেজার নেতৃত্বে ৪ জনের একটি দল। এ ছাড়াও পরিদর্শন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও জলবায়ু সহনশীলতা বিভাগের অধ্যাপক জিল্লুর রহমান। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সৈয়দ আহমেদ কবীরসহ আরও দুইজনের বিশেষজ্ঞ টিম। পরিদর্শন শেষে তারা বলেন, এটা একটি মানব সৃষ্ট দুর্যোগ। এমন আবাসিক এলাকাতে কীভাবে এত রাসায়নিকের মজুত থাকে? এদের কারোর কোনো অনুমতি ছিল না। বিনা অনুমতিতে তারা অবৈধভাবে এতদিন ব্যবসা করে আসছিলেন। এদের সকলের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে জনবহুল এলাকায় যেন আর কোনো এমন রাসায়নিকের গোডাউন গড়ে না ওঠে সেদিকেও আমাদের নজর থাকবে। আমরা সকলে মিলে এ বিষয়ে কাজ করছি।
অগ্নিকাণ্ডের বর্তমান অবস্থা ও উদ্ধার কাজের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেছেন, গত মঙ্গলবার আনুমানিক সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে কেমিক্যাল গোডাউনে লাগা আগুন প্রায় ২৮ ঘণ্টা পর বুধবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা যায়নি। এখনো ঘটনাস্থল থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। আমাদের চারটি ইউনিট কাজ করছে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করার জন্য। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ পর্যন্ত ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তারা বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন আহত বা দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরূপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আরও রয়েছেন- বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. ইয়াছির আরাফাত খান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা জোনের উপ-সহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা, পিও কাম অ্যাডজুটেন্ট মো. সাইদুল আলম চৌধুরী, ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সোহরাব হোসেন, সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. ফসির উদ্দিন।
এদিকে বুধবার ও বৃহস্পতিবার তিন দফায় রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর শিয়ালবাড়ী এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলেও কারোরই লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম দফায় ৬ জনের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ৬ জন হলেন- মাহিরা আক্তার (১৪), নার্গিস আক্তার (১৮), নুরে আলম (২৩), সানোয়ার হোসেন (২২), আব্দুল্লাহ আল-মামুন (৩৯) ও রবিউল ইসলাম রবিন (১৯)। আর বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে প্রথম দফায় পাঁচটি এবং বিকালে দ্বিতীয় দফায় আরও পাঁচটিসহ মোট ১০টি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এদের মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় নারী (১৫), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (৪০), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (৩০), মুনা আক্তার সামিরা (১৪), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (২৬), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (২৮), ফারজানা আক্তার (১৫), মুক্তা বেগম (৩০), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (২০), অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (২০)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপি’র রূপনগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুখলেছুর রহমান লস্কর বলেন, মিরপুরে কেমিক্যাল গোডাউন ও গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ১৬ জনের সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মরদেহের দাবিদারদের সিআইডিতে ডিএনএ নমুনা দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপর যাদের সঙ্গে ডিএনএ স্যাম্পল ম্যাচ করবে পরে তাদের কাছে এসব মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।