Image description

বায়ুদূষণ হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বছরে এক লাখ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। এতে ক্ষয়ক্ষতিও অনেকাংশে কমে আসবে। বায়ুদূষণ ও বাতাসে ক্ষতিকর অতিক্ষুুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। একই সঙ্গে হৃদরোগ, স্ট্রোক, হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুস ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে সূক্ষ্ম কণা বায়ুদূষণের প্রভাব শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ও সিআরইএ যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষণে প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস, যা উৎপাদনক্ষমতা কমাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করছে।

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে প্রতিষ্ঠিত সিআরইএ একটি স্বাধীন গবেষণা সংস্থা, যা বায়ুদূষণ ও এর কারণ এবং জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব ও সমাধান নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বায়ুদূষণের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব মূল্যায়ন করেছে এবং মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দাঁড় করিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিআরইএর বায়ুমান বিশ্লেষক ও এই গবেষণার একজন লেখক ড. জেমি কেলি। সিআরইএ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান ভার্চুয়ালি অংশ নেন।

গবেষণায় বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে বায়ুদূষণের প্রভাব মূল্যায়ন করে দেখা যায়, এখানে বছরে এক লাখ দুই হাজার ৪৫৬ জনের মৃত্যু হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হৃদরোগে, ২৯ হাজার ৯২০ জন। স্ট্রোকে ২৩ হাজার ৭৫ জন, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগে ২০ হাজার ৯৭৬, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ৯ হাজার ৭২০ জন এবং ফুসফুস ক্যান্সারে তিন হাজার ৬৩ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বাতাসে ক্ষতিকর পিএম ২.৫-এর কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বছরে পাঁচ হাজার ২৫৮ জন।

বাংলাদেশের বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায় বাতাসে ক্ষতিকর পিএম ২.৫-এর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম।তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রা এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম।

 

গবেষণার ফলাফল বলছে, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ুমান পূরণের মাধ্যমে এখানে বছরে ১৯ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব। তবে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক বায়ুমান পূরণের মাধ্যমে বছরে ৭৯ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব, যা প্রতিবছর জীবন বাঁচাবে ৮১ হাজার ২৮২ জনের।

গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে : জাতীয় মৃত্যুর ৪৮ শতাংশই এই দুই শহর এলাকায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বায়ুদূষণে বার্ষিক মৃত্যু যথাক্রমে ২৯ হাজার ৫৪৩ ও ২০ হাজার ১৪৩।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাতাসে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর পিএম ২.৫-এর কারণে প্রতিবছর ৯ লাখ অকাল প্রসব হচ্ছে এবং প্রায় সাত লাখ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করছে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে জরুরি বিভাগে ভর্তি হচ্ছে প্রায় ছয় লাখ ৭০ হাজার রোগী। ক্ষতিকর পিএম ২.৫-এর মাত্রা বাংলাদেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ এলাকা ও বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব কম।

গবেষণার প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান বলেন, সিআরইএ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পিএম ২.৫ স্তরে সামান্য উন্নতিও বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা এনে দিতে পারে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি গ্রহণের মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন দর্শনে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য আইন সংস্কারসহ এর কঠোর প্রয়োগ জরুরি।

ঢাকার বায়ুদূষণ শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এখন থেকেই দূষণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ এবং নীতিমালা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পিএম২.৫ বাংলাদশে নিঃসন্দেহ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বায়ুদূষণ কমাতে সরকার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করছে।

বায়ুদূষণকে ঢাকা ও বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন সুইডিশ দূতাবাস বাংলাদেশ-এর ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম। তিনি বলেন, এই সমস্যা মোকাবেলায় অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার উৎপাদন ব্যবস্থা, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা ও প্রণোদনা তৈরি, কার্যকর গণপরিবহন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে বাইরে সব সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত সবার।